সমুদ্রবক্ষের প্রসারণ//SEAFLOOR SPREADING
সমুদ্রবক্ষের প্রসারণ
ভূমিকাঃ ১৯৫০ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
মার্কিন ভূবিজ্ঞানী হ্যারি হ্যামন্ড হেস সমুদ্রবক্ষের
সম্প্রসারণের ধারণা দেন।1962 সালে অধ্যাপক History of Ocean Basin বইটিতে মতবাদটি প্রকাশ
করেন।
পূর্ব ধারণাঃ-
ফ্রান্সিস বেকন এর আটলান্টিক মহাসাগর সৃষ্টি,ওয়েগনার এর
মহাদেশীয় সঞ্চালন, আর্থার হোমসের তাপীয় পরিচালন স্রোত ইত্যাদি ধারণা হ্যারি হেসকে
নতুন ভূগাঠনিক ধারণা তৈরিতে উৎসাহিত করে।
মূল বক্তব্য (Main Concept of Sea floor spreading):
-
১.হোমস এর 'পরিচলন স্রোত তত্ত্ব' এর ভিত্তিতে তিনি বলেন
ভূ অভ্যন্তরের উত্তপ্তে ম্যাগমার পরিচলন স্রোতের
প্রভাবে ঊর্ধ্বমুখে স্থানান্তরিত হয় ফলে উপরের
অংশে মহাসাগরীয় ভূত্বক ফেটে বা গলে গিয়ে
অসংখ্য ফাটল ও চ্যুতি রেখা সৃষ্টি হয়। এই ফাটল বরাবর ম্যাগমা বাইরে বেরিয়ে এসে সঞ্চিত
হয়ে শৈলশিরা গঠন করে। পরে সমুদ্র বক্ষের বিস্তার ঘটতে থাকে,ম্যাগমা নির্গমনের সময়
প্রবল চাপে ভূত্বক পাশের দিকে বিস্তার লাভ করে এবং মাঝের ফাঁকা অংশে লাভা জমে নতুন
ভূত্বক সৃষ্টি হয়। এর ফলে মহাসাগরের দুদিকের সীমানায় অবস্থিত মহাদেশীয় ভূত্বক পরস্পর
থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে।সমুদ্র তলদেশের ক্রমশ প্রসারের সঙ্গে পুরানো ভূত্বকীয়
অংশের বিনাশ ঘটে।হেস মতে, পরিচলন স্রোতের নিম্নমুখী বাহু, বরাবর মহাসাগরীয় ভূত্বক
অংশে ঢুকে যায়। তাই কনভেয়ার বেল্টের মতো সামুদ্রিক শৈলশিরা থেকে বাইরের দিকে বিস্তার
লাভ করে প্রান্তভাগে সামুদ্রিক খাতে শেষ হচ্ছে। সমুদ্রবক্ষের প্রসারণের হার বছরে কয়েক
সেমি থেকে ১০ সেমি। আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশ বছরে গড়ে ২ সেমি প্রসারিত হওয়ায় এটি
গঠনে প্রায় ২০ কোটি বছর লাগে।
সমুদ্র বক্ষের বিস্তারের প্রক্রিয়া:-
১.তাপ সৃষ্টি:
হ্যারি হেসের মতে ভূগর্ভে 100 থেকে 2900 কিলোমিটার গভীরতায়
অবস্থিত গুরুমন্ডলে বা ম্যাণ্টেলে তেজস্ক্রিয়
পদার্থের প্রভাবে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় যেটি সমুদ্র তলদেশের সম্প্রসারণ এর একটি প্রধান
কারণ।
২.পরিচলন স্রোতের
উদ্ভব: ভূ অভ্যন্তরের উত্তপ্তে ম্যাগমার পরিচলন
স্রোতের প্রভাবে ঊর্ধ্বমুখে স্থানান্তরিত হয়
ফলে উপরের অংশে মহাসাগরীয় ভূত্বক ফেটে বা
গলে গিয়ে অসংখ্য ফাটল ও চ্যুতি রেখা সৃষ্টি হয়। এই ফাটল বরাবর ম্যাগমা বাইরে বেরিয়ে
এসে সঞ্চিত হয়ে শৈলশিরা গঠন করে।
৩.মহাদেশের স্থানান্তর:
মধ্য মহাসাগরীয় শৈলশিরা থেকে পরিচলন স্রোতের অনুভূমিক
ও বহির্মুখী প্রবাহ শৈলশিরার দুপাশে অবস্থিত মহাদেশীয় ভূখণ্ডকে দুপাশে ঠেলে সরিয়ে
দেয়।
৪.নবীন মহাসাগরীয় ভূত্বক গঠন ও সমুদ্র বক্ষের বিস্তার:
মহীসঞ্চরণ এর ফলে মধ্য মহাসাগরীয় শৈলশিরার দুপাশে নতুন
মহাসাগরের তলদেশ তৈরি হয় ও মহাসাগরের তলদেশ ক্রমশ সম্প্রসারিত হতে থাকে।
৫.পুরাতন মহাসাগরীয়
ভূত্বকের বিন্যাস:
নতুন মহাসাগরীয় ভূত্বক মধ্য মহাসাগরীয় শৈলশিরা থেকে
দুপাশে যত সম্প্রসারিত হয়, পুরাতন মহাসাগরীয় ভূত্বক তত মহাসাগরের প্রান্তে অবস্থিত
সমুদ্রখাতের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং ভূগর্ভে বিনষ্ট হয়।
সমুদ্র বক্ষের বিস্তৃতি সংক্রান্ত প্রমাণ[Evidence of
seafloor spreading]:-
১.অবক্ষেপের বয়সঃ মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরা থেকে যত দূরে
অগ্রসর হয়, তত মহাসাগরীয় ভূত্বকের অবক্ষেপের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নিচের স্তরটি
বেশী প্রাচীন হয়ে থাকে। মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরা থেকে যত দূরে যাওয়া যায় মহাসাগরীয় ভূত্বকের
বয়স ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
মহাসাগরের তলদেশে পেরিডোটাইট নামক আগ্নেয় শিলার মধ্যে
সারপেন্টাইন নামক নিজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।বিজ্ঞানীদের মতে খনিজের কিছু উপাদানের
জোগান আসে ভূগর্ভের গুরুমন্ডল থেকে।
২.আগ্নেয়শিলার বয়সঃ 1966 সালে সামুদ্রিক ভূত্বকের আগ্নেয়
শিলার নমুনা থেকে RADIOMATRIC পদ্ধতিতে শিলার বয়স নির্ধারণ করা হয়।মধ্য সামুদ্রিক
শৈলশিরা থেকে ক্রমশ বাইরের দিকে শিলার বয়স বৃদ্ধি পায়।
৩. JOIDES প্রকল্পঃ মার্কিন US নেশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন
1968 সালে JOIDES নামক প্রকল্প গ্রহণ করে।সংস্থাটি গ্লোমোর চ্যালেঞ্জার নামক জাহাজ দ্বারা সংগৃহীত
আটলান্টিক মহাসাগরের নমুনা পরীক্ষা করে দেখে যে মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরা থেকে উপকূলের
দিকে গভীরতা ও বয়স বৃদ্ধি পায়।
৪. ভূমিকম্প কেন্দ্রের অস্তিত্বঃ ভূ বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য
করেছেন যে মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরার নীচে অসংখ্য
ভূমিকম্পের কেন্দ্র গুলি সব সময় একই গভীরতায় অবস্থান ওই অঞ্চলের অস্থিতিশীল অবস্থা
প্রমাণ করে।
৫. পুরা চুম্বকীয়
বিশ্লেষণঃ মধ্য মহাসাগরীয় শৈলশিরার দুপাশে সমান দূরত্বে সমান চরিত্রের ভূচৌম্বকীয়
প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।এতে প্রমাণিত হয় যে মহাসাগরীয় শৈলশিরার দুপাশে সমুদ্র তলদেশের
সম্প্রসারণ এর হার সমান।
৬. আটলান্টিক মহাসাগরীয় শৈলশিরা এবং উত্তর আটলান্টিকের
ভূত্বকের 2-3 কিলোমিটার গভীর এলাকা থেকে শিলার যে নমুনা বিজ্ঞানীরা সংগ্রহ করেছেন,তাতে
প্রমাণিত হয়েছে যে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরীয় ভূত্বকের নিচে 2-3 কিলোমিটার গভীরতায় তীব্র তাপপ্রবাহ আছে।এতে বোঝা যায় যে গুরুমন্ডল
থেকে তাপের ঊর্ধ্বমুখী স্রোত আছে,ফলে ক্রমাগত ভূ-পৃষ্টের দিকে উঠে আসছে যা সমুদ্র তলদেশের
সম্প্রসারণ এর জন্য জরুরী।
৭.ফেমাস প্রকল্পঃ 1971 সালে ফেমাস (French American
mid ocean undersea study)প্রকল্পে মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরার উত্তর ভাগে দুই থেকে তিন
কিমিঃ গভীরে খনন করে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।ভূত্বকের নিচে তীব্র তাপপ্রবাহ,ম্যাগমা চেম্বার,শৈলশিরার
সমান্তরাল ফাটল ইত্যাদির উপস্থিতি জানা যায়।এটি সামুদ্রিক ভূত্বকের প্রসারণশীলতা সুস্পষ্ট
প্রমাণ।
৮. মার্কিন অধ্যাপক J T WILSON 1965 সালে পাতসংস্থান তত্ত্বে
বলেন,প্রসারণশীল ভূখণ্ড বা পাত অক্ষাংশ বরাবর সরে যাওয়ার ফলে মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরার
শীর্ষদেশের নতুন শিলায় টান পড়ে চ্যুতি ও সংস্র উপত্যকা সৃষ্টি হয় এবং সমুদ্রবক্ষ
চ্যুতিরেখা বরাবর সমকোণে দুপাশে সরে গিয়ে ট্রানসফর্ম চ্যুতির সৃষ্টি করে।
৯. জীবাশ্মের উপস্থিতিঃ মহাসাগরের উভয় দিকের উপকূল ও
মহীঢালের একই রকম আকৃতি ও উপকূল অঞ্চলে জীবাশ্মের উপস্থিতি প্রমাণ করে অঞ্চলগুলি এক
সময় একই স্থানে অবস্থিত ছিল এবং পরে সমুদ্রতল সৃষ্টির ফলে তারা সরে গেছে।
১০.গায়টঃ মহাসাগরের তলদেশে গায়ট নামে এক ধরনের চ্যাপ্টা
মাথার পাহাড় বা আগ্নেয়গিরি আছে।বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে মহাসাগরের তলদেশ সম্প্রসারিত
হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গায়ড গুলিও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
0 Comments