Ad Code

Ticker

7/recent/ticker-posts

নদ-নদীর উপর মানবজাতির প্রভাব// Impact of human on river




নদ-নদীর উপর মানবজাতির প্রভাব


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন---

"আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে 

বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। 

পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি, 

দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।"

আমাদের ভারত হল নদী মাতৃক দেশ আর মানুষের সঙ্গে এই নদীর এক আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। সেই সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই নদীকে কেন্দ্র করে সভ্যতার পত্তন ঘটেছিল। আর নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষ তার বসতি স্থাপন থেকে শুরু করে জীবনযাত্রা নির্বাহের পথ খুঁজে পেয়েছিল। নদীর তীরে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল আফ্রিকার হাড্ডার অঞ্চলের মানবজাতি। আদি অনন্ত কাল থেকেই নদী ব্যবসা বাণিজ্যের, জনবসতি স্থাপনের, কৃষিকাজ, শিল্প ক্ষেত্রে ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রাচীনকাল থেকেই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল বড় বড় সভ্যতা যেমন নীল নদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মিশরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে সিন্ধু সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীকে ঘিরে সুমেরীয় সভ্যতা এবং চীনের হোয়াংহো ও ইয়াং সিকিয়াংকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে চৈনিক সভ্যতা। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে নদীর সাথে মানুষের এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই নদী ও মানবজাতির সম্পর্কে কিছুটা ছেদ পড়েছে। যে নদীকে কেন্দ্র করে মানবজাতি একদিন উন্নয়নে শিখরে পৌঁছনোর যাত্রা শুরু করেছিল এবং মানব সভ্যতার উন্নতিতে নদীর ভূমিকা অপরিসীম, সেই নদীকে আজ মানুষ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে নানা ভাবে। আমাদের অসচেতনতা এবং উদাসীনতার কারণে অনেক নদ-নদী আজ সংকটের মুখে, কোনো কোনো নদী আবার হারিয়ে গেছে, কেউ কেউ নিজের গতি পরিবর্তিত করে বয়ে চলে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। নদী ও মানবজাতি একে অন্যের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে। তবে এই প্রভাবের কিছু সদর্থক ও নঞর্থক দিক রয়েছে। 

প্রথমে সদর্থক দিকগুলোর দিকে আলোকপাত করা যাক।

কৃষিকাজ : আমাদের ভারতে ৬০% মানুষ কৃষিকাজের সাথে যুক্ত, তাই নদীর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল কৃষি। নদীর তীরে উর্বর পলিযুক্ত মাটি কৃষিকাজের জন্য উপযোগী। সেই উর্বর মাটিতে ফসল উৎপাদন করে ভারতীয় অর্থনীতিকে সাহায্য করে চলেছে। রবি শস্য, খারিফ শস্য, জাইদ শস্য চাষাবাদের জন্য নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। কোথাও কোথাও আবার নদী থেকে খাল কেটে সেচের কাজে লাগিয়েছেন। ফলে নদীর এই বহুমাত্রিক ব্যবহার মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে।

শিল্পাঞ্চল : নদী যে কতভাবে মানুষকে সাহায্য করে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল ভারতে গড়ে ওঠা বৃহৎ বৃহৎ শিল্পাঞ্চল। যেমন - পূর্ব ভারতে হুগলি নদীকে কেন্দ্র করে পাট শিল্প গড়ে উঠেছে। ব্রাহ্মণী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে রৌরকেল্লা ইস্পাত কেন্দ্র। দামোদর নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দুর্গাপুর লৌহ ইস্পাত শিল্পকেন্দ্র। এরকম অজস্র উদাহরণ আছে যেখানে নদীকে কেন্দ্র করে বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

ধর্মীয় স্থান : নদ-নদীর সাথে ধর্মীয় স্থানের ও ভারতীয় সংস্কৃতির এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। ছোট বড়ো নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ধর্মীয় শহর এবং ধর্মীয় স্থান। যেমন - গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হরিদ্বার, ঋষিকেশ, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ। গঙ্গাকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে পবিত্র নদী রূপে পূজিত হয়। মানুষ বছরের বিভিন্ন সময় গঙ্গায় পুণ্য স্নানের মধ্যে দিয়ে পুণ্যার্জন করেন। এছাড়া ছট পূজা, বারুণীস্নান প্রভৃতি নদীকে কেন্দ্র করেই আয়োজিত হয়।

জীবিকা নির্বাহের বিকল্প পথ : কৃষিকাজ, শিল্প, ধর্মীয় স্থান ছাড়াও নদীর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। প্রাথমিকভাবে যে কাজগুলো মানুষজন করে থাকে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল মৎস্য শিকার। ছোট বড় অসংখ্য নদীর সম্ভার রয়েছে আমাদের এই দেশে। নদী থেকে মাছ সংগ্রহ করে বাজারজাত করে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন মৎস্যজীবীরা।


এগুলো সবই ভালোদিক অর্থাৎ নদীর সাথে মানুষের সম্পর্কের কিছু ইতিবাচক দিক। এবারে আসা যাক নঞর্থক দিকগুলোতে যার ফলে নদীগুলো যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ইতিবাচক দিকের তুলনায় নেতিবাচক প্রভাবই বেশী।


জলদুষণ : দূষণের জন্য যতই আইন আসুক না কেন, দূষণ সে জলই হোক বা বায়ু, নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। সারা ভারত জুড়ে অসংখ্য নদী রয়েছে আর সব নদীই কম বেশী দূষিত। জলদূষণ যে কি পরিমাণে হয়ে চলেছে তা আমরা প্রতিনিয়ত সংবাদপত্র বা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানতে পারি। গঙ্গা দূষণ কোনো অজানা বিষয় নয়। যে গঙ্গাকে আমরা পবিত্র রূপে পুজো করি তাকেই আমরা যথেষ্ট হারে দূষিত করছি।  ২০১৯ সালে দীপাবলির সময়ে যমুনা নদীর দূষণের চিত্র দেখি। এইরকম অজস্র জলদুষণের চিত্র ফুটে উঠবে নানা দিক থেকে।

নগরায়ন : নগরায়ণ একটি বড় সমস্যা। কারণ নেতিবাচক প্রভাবের ক্ষেত্রে নগরায়নের ভূমিকা রয়েছে। শহরতলিতে অবস্থিত বাড়ির আবর্জনা, কর্পোরেশনের আবর্জনা মিশ্রিত বর্জ্য সবটাই নদীর জলে মিশছে। বর্জ্য পদার্থ মিশ্রিত জলের কারণে জলজ প্রাণীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতের বড় বড় নগরায়ন নদীকে কেন্দ্র করে হয়েছিল। গঙ্গা দূষণের ক্ষেত্রে মহানগরী কলকাতার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।

নদীর গতি পরিবর্তন করে বাঁধ নির্মাণ : নদী গতিপথে বাঁধ তৈরী হওয়ার ফলে নদী ক্রমাগত তার গতি পরিবর্তন করছে। ফলে নদীর প্রবাহ অনিত্যবহ হয়ে পড়ছে। এছাড়াও নদী বুকে চড়ার সৃষ্টি হয়েছে এবং নদী প্রবাহপথে নাব্যতার ফলে মৎস্য পরিব্রাজনে অসুবিধা দেখা দিচ্ছে।

শিল্পায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা : নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানা এখন নদীর কাছে অভিশাপের মতো। কারণ কলকারখানা থেকে নির্গত বিভিন্নপ্রকার বর্জ্য, এমনকি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য জলে মেশায় নদীর বেহাল দশা হয়ে পড়েছে। এছাড়াও যে নদী একদিন যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যম হিসেবে সাহায্য করেছে তাকেই আজ মানুষ অপব্যবহার করছে। যেমন বড় বড় জাহাজ থেকে তেল নিঃসৃত হয়ে নদীর জলে মেশে ফলে নদীর জল দূষিত হয় শুধুমাত্র তাই নয়, জলজ বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে। মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য : অসাধু ব্যবসায়ীরা নদীর চর থেকে অনবরত বালি উত্তোলনের করে চলেছে, যার ফলে নদীর ওপর মারাত্মক ভূমিরূপগত প্রভাব পড়ছে। এতে বর্ষার জলে নদী পরিপূর্ণ হলে ওই জায়গাতে ঘূর্ণির সৃষ্টি হচ্ছে।


পরিশেষে বলা যায় যে, সুফল ও কুফল দুই দিক তুলনা করলে দেখা যাবে কুফলই বেশী। নদী আমাদের যতটা সুযোগ দিয়েছে মানুষ তার দ্বিগুণ হারে অপব্যবহার করছে। মানুষের উদাসীনতা ও অসচেতনতা প্রধান কারণ। যদি ভবিষ্যতে সুস্থ পরিবেশ উপহার দিতে হয় তবে সচেতন হওয়া দরকার। অনেক নদী সংস্কারের মাধ্যমে বাঁচিয়ে তোলা দরকার ভীষণভাবে। তাই মানবজাতির উচিৎ সকলে একত্রিত হয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া যে আর নদীর অপব্যবহার নয়, এবারে সুস্থ করে তুলব নদীগুলোকে।


লেখিকাঃ- সায়ন্তনী সিং (নিমতলা, আন্দুলরোড, হাওড়া)

[লেখিকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল স্নাতকোত্তর বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী। বর্তমানে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে  শিক্ষাকতা করেন ] 

তথ্যসূত্রঃ- ResearchGate ; ScienceLearn ; Nature ; Bhugol o Poribesh ; Wikipedia

প্রথম প্রকাশ ঃ ৩০/৪/২০২১ 

©ভূগোলিকা-Bhugolika

#ভূগোলিকা_Bhugolika

Reactions

Post a Comment

0 Comments

Ad Code