Ad Code

Ticker

7/recent/ticker-posts

বিশ্বে প্রাণীর ভৌগোলিক বণ্টন



 বিশ্বে প্রাণীর ভৌগোলিক বণ্টন

*******************************************

“Present is the key to the Past” -- জেমস হাটনের বিখ্যাত উক্তি। তাঁর মতে বর্তমানে বহির্জাত প্রক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলি অতীতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সেরকমই কোন অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্র্য, বাস্তুতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য অতীতের সাথে সম্পর্কিত। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে শুধুমাত্র প্রাণী গোষ্ঠীর বণ্টন তুলে ধরা হয়েছে। প্রাণী ভূগোল জীব ভূগোলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারা বিশ্বব্যাপী প্রাণীর বণ্টন ও তাদের উৎপত্তি, বিবর্তন এর প্রধান বিষয়। কি এই প্রাণী ভূগোল? জীব ভূগোলের যে শাখায় মূলত প্রাণীর  ভৌগোলিক বণ্টন নিয়ে আলোচনা করা হয়, তাকেই প্রাণী ভূগোল বলে। ভূ-তাত্ত্বিক কালক্রম অনুসারে দেখা যায় ভূ-বিবরণীর বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন প্রাণীর উদ্ভব, তাদের বিলুপ্তি ও বণ্টন। বিশ্বে প্রাণীর বণ্টন কতগুলি বিষয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যেমন -- প্রাকৃতিক পরিবেশ (জলবায়ু , তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, স্বাভাবিক উদ্ভিদ), অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ (উলম্ব ও অনুভূমিক বণ্টন), প্রাণীর পরিগমন ও পরিব্রাজন প্রভৃতি। বর্তমানে মোট প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা ৮.৭ মিলিয়ন। ১৮৫৮ সালে প্রথম Sclater বিশ্বকে ছয়টি প্রাণী প্রদেশে ভাগ করেন। পরবর্তীকালে ১৮৭৬ সালে Alfred Russel Wallace যাকে "father of bio- geography" বলা হয়, তিনি তাঁর লেখা বিখ্যাত বই "The Geographical Distribution of Animals (১৮৭৬)" এরূপ বিভাজন করেন। সংখ্যাগত বা মাত্রিক বিশ্লষনের মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে ছয় ভাগে ভাগ করেন। তিনি বলেন, "It will be evident in the first place that nothing like perfect zoological division of the earth is possible. The causes that have led to the present distribution of animal life are so varied, their action and reaction have been so complex that anomalies and irregularities are sure to exist which will mar the symmetry of any rigid system"। Wallace বিশ্বকে প্রাণীর নিরিখে যে ছয়ভাগে ভাগ করে ছিলেন সেগুলি হল -- (ক) প্যালিআর্কটিক অঞ্চল (PALEARCTIC REGION), (খ) নিওট্রপিক্যাল অঞ্চল (NEOTROPICAL REGION), (গ) ওরিয়েন্টাল অঞ্চল (ORIENTAL REGION), (ঘ) ইথিওপিয়ান অঞ্চল (ETHIOPIAN REGION), (ঙ) অস্ট্রেলিয়ান অঞ্চল (AUSTRALIAN REGION) এবং (চ) নিআর্কটিক অঞ্চল (NEARCTIC REGION) 


★ প্যালিআর্কটিক অঞ্চলঃ- 

মূলত ইউরোপ মহাদেশ, মধ্য ও উত্তর এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাংশ জুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে প্রধানত তুন্দ্রা, নাতিশীতোষ্ণ এবং পর্ণমোচী বৃক্ষের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। এই অঞ্চলে ১৩৬ টি গোত্রযুক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণী, ১০০ টি বর্গের ও ৩৩ টি গোত্রের স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৪ টি প্রজাতির পক্ষী শ্রেণী লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও ২৮ টি কর্ডাটা পর্বের প্রাণী পাওয়া যায়। কিছু উল্লেখযোগ্য প্রাণী হল রাশিয়ান দেসম্যানস্ (Russian desmans),  ইউরেশিয়ার ডরমিস (Dormice) এবং ভূমধ্যসাগরের গন্ধমূষিক ইঁদুর (Mole rats), কৃষ্ণসারমৃগ (Saiga and chiru antelope), আসেন্টর (Accentors) প্রভৃতি। এখানে সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা অনেক কম অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায়। এখানে যেসব সরীসৃপের দেখা মেলে সেগুলি হল -- টিকটিকি, কুমীর, ঘড়িয়াল, সাপ,  এমিদাইন কচ্ছপ (Emydine turtles)। এখানে ৫৩ টি বর্গের পক্ষীর সন্ধান পাওয়া গেছে। ফিজ্যান্ট (Pheasants), রেন্স (Wrens), ওয়ারব্লার (Warblers), বাজপাখি, কাঠঠোকরা, সোয়াল, ফিঞ্চ প্রভৃতি। এছাড়া মেরু অঞ্চলে গ্রাউস, ক্রিপার প্রভৃতি পাওয়া যায়। কিছু উভচর প্রাণী যেমন -- ইউরোপের সালাম্যান্ডার, জাপান ও চিনে বৃহৎ আকৃতির (৫ ফুট লম্বা) সালাম্যান্ডার দেখা যায়। এছাড়া প্রোটিয়াস, নেকুটাস, আলাইটিস, হাইলা প্রভৃতি পাওয়া যায়।



★ নিওট্রপিক্যাল অঞ্চলঃ- 

সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল জুড়ে ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত এই অঞ্চল বিস্তৃত। এই অঞ্চলে কিছু বিশেষ ধরনের প্রাণীর সন্ধান মেলে যা বিশ্বের কোথায়ও পাওয়া যায় না। দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূলে আমাজন ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য অন্যদিকে প্যাটাগোনিয়া মরুভূমির অবস্থান পশ্চিম উপকূলে। সুতরাং এখানে বিভিন্ন প্রাণীর বৈচিত্র দেখা যায়। ওয়েগনার এর Continental Drift Theory অনুযায়ী দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা পূর্বে একত্রিত রূপে অবস্থান করত ফলে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে প্রাণীর সাদৃশ্য দেখা যায়। অস্টিওগ্লসিড ও লাংফিশ জাতীয় মৎস্য মূলত আফ্রিকা থেকে প্রসারিত হয়েছে। এছাড়াও ক্যাটফিশ, ঈল, গারপ্রিক প্রভৃতি পাওয়া যায়। এখানে ১৬৮ টি পরিবার ভুক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৪৪ টি স্থানীয় বা আদিম প্রজাতি, ১৩০ টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী যার মধ্যে ১০৩ টিই স্থানীয়, ৬৮৩ টি পক্ষীর সমাবেশ মেলে তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হামিং বার্ড, টুকান, চ্যাটার, প্লান্টক্যাচার, থ্রাস সহ আরও অনেক পাখির সমাবেশ দেখা যায়। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ক্যাঙ্গারু, বানর, আর্মাডিলো, শ্লথ প্রভৃতি দেখা যায়। মরুভুমি অঞ্চলে প্রধানত বাজ, আর্মাডিলো দেখা যায়। 



★ ওরিয়েন্টাল অঞ্চলঃ-

ওরিয়েন্টাল অঞ্চল মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত দেশসমূহকে নিয়ে গঠিত। ভারতীয় উপমহাদেশ, চিনের দক্ষিণাংশ, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ এ অঞ্চলের অন্তর্গত। এখানে দেখা যায় ১৬৪ গোত্রের মেরুদণ্ডী প্রাণী যার মধ্যে ১২ টি গোত্র স্থানীয় মেরুদণ্ডী প্রাণী, ১১৮ টি স্তন্যপায়ী যার মধ্যে ৫৫ টি স্থানীয় প্রকৃতির এবং ৩৪০ টি প্রজাতির পক্ষী যার মধ্যে ১৬৫ টি স্থানীয়। এই অঞ্চলে বসবাসকারী কিছু উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রজাতি হল হাতি, সিংহ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, গন্ডার, নেকড়ে, চিতা, বানর, বন্য কুকুর ও বন্য বিড়াল প্রভৃতি। এই অঞ্চলে দেখা মেলে কাঠঠোকরা, বাজ, পায়রা, শ্যামা, ফিঙে, দোয়েল, বাবুই, কাক এবং দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে আগত ফ্রগ মাউথ এবং উড সোয়াল প্রভৃতি। তাছাড়া এখানে কিছু উভচর ও মাছের প্রজাতি লক্ষ্য করা যায় সেগুলি যথাক্রমে হল -- ব্যাঙের প্রজাতি, ইকতিওফিশ, ইরিওতিফ্লাস, সালাম্যান্ডার এবং স্বাদু জলের মাছ যেমন - কাতলা, রুই, মাগুর, কালবোস, শোল শাল প্রভৃতি। সরীসৃপ প্রাণীগুলি হল -- টিকটিকি, গিরগিটি, গোসাপ এবং বিভিন্ন প্রকারের সাপ।



★ ইথিওপিয়ান অঞ্চলঃ-

ইথিওপিয়ান অঞ্চল মূলত সাহারার দক্ষিণাংশে সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ও আরবীয় উপদ্বীপীয় অঞ্চল নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চলে ১৭৪ টির মধ্যে ২২ টি স্থানীয় প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী, ১৪০ টির মধ্যে ৯০ টি স্থানীয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৭৯ টির মধ্যে ১৭৯ টির স্থানীয় পক্ষীর সন্ধান পাওয়া গেছে। উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলি হল -- জলহস্তী, জিরাফ, অ্যান্টিলোপ, সিংহ, শেয়াল, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বানর, লেমুর প্রভৃতি। এছাড়াও পেঁচা, মাছরাঙা, বাজপাখি, সোয়াল, উটপাখি, স্টালিং, অরিয়ল, ব্রডবিল হর্ণবিল গিনি প্রভৃতি পাখির সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। কিছু উল্লেখযোগ্য সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী হল -- বয়া, বোরা, পাইথন, কেউটে, ভাইপার, টিকটিকি, কচ্ছপ, কুমীর, ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, সিসিলিয়ান প্রভৃতি।


★ অস্ট্রেলিয়ান অঞ্চলঃ-

এই অঞ্চলটি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং তাসমানিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, সলোমন, সামোয়া দ্বীপসমূহ নিয়ে গঠিত হয়েছে। এখানে ১৪১ টি পরিবার ভুক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণী যার ২২ টি স্থানীয়, ৭২ টি প্রজাতির যার ৪৪ টি স্থানীয়, ২৯৮ টি প্রজাতির পাখির বসবাস দেখা যায়। এই অঞ্চলে ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় উভয় জলবায়ু লক্ষ্য করা যায়। মারসুপিয়াল অর্থাৎ কাঙ্গারু প্রধান স্তন্যপায়ী প্রাণী। এছাড়াও বাদুড়, ইঁদুর, ছুঁচো, কুকুর এবং খরগোশ ইত্যাদি পাওয়া যায়। অস্টিওগ্লসিড এবং নিওসেরাটোডাস এই অঞ্চলের প্রধান মৎস্য। ৯০% অস্ট্রেলিয়ার জুড়ে লেপ্টোডাক্টিলিড ও হাইলিড ব্যাঙ উভচর প্রাণী লক্ষ্য করা যায়। মাছরাঙা, বাজপাখি, কোকিল, লরিস ইত্যাদি পাখি দেখা যায়। 



★ নিআর্কটিক অঞ্চলঃ- 

উত্তর আমেরিকা ও গ্রিনল্যান্ড নিয়ে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অন্তর্গত এই নিআর্কটিক অঞ্চল। টার্সিয়ারি ও প্লিস্টোসিন যুগে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ একসাথে অবস্থানের কারণে খুব সহজেই সেখানকার প্রাণী গোষ্ঠী একস্থান থেকে অন্য স্থানে পরিব্রাজন করত। ফলে প্যালিআর্কটিক ও নিআর্কটিক প্রাণী গোষ্ঠীর মধ্যে সাদৃশ্য দেখা যায়। তাই অনেক বিজ্ঞানী এই দুই অঞ্চলকে হোলআর্কটিক অঞ্চল বলেন। এখানে ১২২ গোত্রের মেরুদণ্ডী প্রাণী, ১৬৯ প্রজাতির পক্ষী, ৭৪ টি স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১২ টি অমেরুদণ্ডী প্রাণী লক্ষ্য করা যায়। এখানে ২৪ টি স্থানীয় গোত্রের স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায় যেমন - রোডেন্ট (Rodent), পকেট গোফার (Pocket gophers), মাউন্টেন বিভার (Mountain beavers), প্রোঘনস্ (Proghons)  প্রভৃতি। এছাড়াও খরগোশ, কাঠবেড়ালি, ইঁদুর, বাদুড়, হরিণ দেখা যায়। অন্যদিকে ৩৯ টি গোত্রের পক্ষী বেশী সংখ্যায় পাওয়া যায়। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পক্ষী হল -- পাতিহাঁস, বাজপাখি, মাছরাঙা, ফিঞ্চ প্রভৃতি যা সর্বত্র পাওয়া যায়। তাছাড়া হামিং বার্ড, ওয়াক্স উইং , টার্কি প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। সরীসৃপ প্রাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -- র‍্যাটল, পাইথন, বোরা, কুমীর, কচ্ছপ প্রভৃতি। স্যালাম্যান্ডারই উভচর প্রাণীর মধ্যে প্রধান, তাছাড়াও ব্যাঙ, সাইরেন ও অ্যামাফিউরা দেখা যায়। 


পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বর্তমানে পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, জনসংখ্যার চাপ এবং বৃক্ষচ্ছেদন ও দাবানলের কারণে অনেক প্রাণী আজ বিপন্নের পথে আবার অনেক প্রাণীর অবলুপ্তিও ঘটে গেছে। সুতরাং সকল মানুষকে সচেতন ও সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে এই বিপন্ন প্রাণীর সংরক্ষণ করা উচিৎ। 


*******************************************

লেখিকাঃ- সায়ন্তনী সিং (পাঁচপাড়া, নিমতলা, হাওড়া)

তথ্যসূত্রঃ- জীব ভূগোল - ডঃ নিখিল কৃষ্ণ দে এবং ডঃ সৌম্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় ; Bio Geography - Savindra Singh ; Wikipedia ; World Zoogeography Region


Reactions

Post a Comment

0 Comments

Ad Code