মৃত্তিকা ক্ষয়ের কারণগুলি আলোচনা করো// what are causes of soil degradation?
মৃত্তিকা একটি প্রাকৃতিক উপাদান, তাই প্রকৃতির নিয়মে যার সৃষ্টি আছে তার আবার ধ্বংসও আছে। মৃত্তিকা পৃথিবীর বাহ্যিক স্তর তথা শিলামন্ডল বা ভূপৃষ্ঠের বহিঃ অংশ হওয়ায় বিভিন্ন বহির্জাত প্রক্রিয়া গুলির দ্বারা সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে মৃত্তিকার উপরিভাগ ধীরগতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বর্তনামে মানুষের বিভিন্ন কার্যাবলীর দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় প্রাপ্ত হচ্ছে।
ভূমিক্ষয় (Soil Erosion) মৃত্তিকা ক্ষয় বা ভূমিক্ষয় কাকে বলে ?
মৃত্তিকা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে ও মানবীয় কার্যাবলীর দ্বারা মৃত্তিকার উপরিভাগ যখন অত্যন্ত ধীরগতিতে বা দ্রুতগতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখন তাকে সাধারণভাবে মৃত্তিকা ক্ষয় বলে
বায়ুর কার্যের ফলে মাটি ক্ষয়
সাধারণত গাছপালা হীন মৃদু ঢাল যুক্ত শুষ্ক ভূমি ভাগে মৃত্তিকা স্তর আলগা হওয়ায় বায়ুপ্রবাহ দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় সর্বাধিক হয়। প্রবল বায়ু প্রবাহের দ্বারা শিথিল মৃত্তিকা কণা একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবাহিত হওয়ার ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় ঘটে।
মাটির আলগা কনা গুলির আকৃতির উপর নির্ভর করে বায়ু তিনটি পদ্ধতিতে ক্ষয় করে থাকে। যথা -
ভাসমান ক্ষয় - অতি সূক্ষ্ম কণা অর্থাৎ ০.১ মিমি বা তার কম ব্যাস যুক্ত ধূলিকণা যখন বাতাসে ভেসে থাকা অবস্থায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়, তখন তাকে ভাসমান ক্ষয় বলে।এর আরেক নাম হল প্রলম্বন ।
লম্ফদান ক্ষয় - সাধারণত মাটির কণা যদি ০.১ মিমি থেকে ০.৫ মিমি ব্যাস যুক্ত তখন মাটির কণা গুলি বায়ুর দ্বারা ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে লাফিয়ে লাফিয়ে অগ্রসর হয় হওয়ার পদ্ধতিকে লম্ফদান ক্ষয় বলে। লম্ফদান প্রক্রিয়ার দ্বারা বায়ু প্রবাহ সবচেয়ে বেশি পরিমানে ক্ষয় করে থাকে।
গড়ানে প্রক্রিয়া -মাটির মোটা কণা যাদের ব্যাস ০.৫ মিমি থেকে ১ মিমি, সেগুলি বায়ুর দ্বারা ভাসমান অবস্থায় বেশি দূর প্রবাহিত হতে পারে না, তারা বায়ুর টানে ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে এগিয়ে যায়, একে গড়ানে প্রক্রিয়া বলে।
বৃষ্টিপাত ফলে মাটির ক্ষয়ঃ
বৃষ্টিপাত শুধুমাত্র জলপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই নয়, মৃত্তিকা ক্ষয়েও প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। বৃষ্টির ফোঁটা মৃত্তিকার ওপর আঘাত করে তার দ্বারা দানাকৃতি গঠনকে ভেঙে মৃত্তিকার কণাগুলিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মৃত্তিকার এই বিচ্ছিন্ন কণাগুলি জল স্রোতে ভেসে যায়। ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।কত সময় ধরে কী পরিমানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তার দ্বারা বহুলাংশে মৃত্তিকা ক্ষয়ের প্রকৃতি ও পরিমান নির্ভর করে। অল্প সময় ধরে প্রচুর পরিমানে বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টির জল অতি দ্রুত পৃষ্ঠ প্রবাহ রূপে প্রবাহিত হয় বলে চাদর ক্ষয়ের দ্বারা প্রচুর পরিমান মৃত্তিকা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। আবার দীর্ঘ সময়ে ধরে ঝিরঝিরে বৃষ্টিপাত হলে অধিক পরিমান জল অনুস্রাবনের মাধ্যমে ভূগর্ভে প্রবেশ করে বলে পৃষ্ঠ প্রবাহ কমে গিয়ে মৃত্তিকা ক্ষয় কম হয়।আবার বৃহৎ আকারের বৃষ্টির ফোঁটা অতি দ্রুত বেগে নিচে পতিত হলে মৃত্তিকার উপরের স্তর বৃষ্টির ফোঁটার আঘাতে আলগা হয়ে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র বৃষ্টির ফোঁটার দ্বারা মৃত্তিকা তেমন একটা ক্ষয় হয় না।
বৃষ্টিপাত দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয়ের পদ্ধতি সমূহ:
স্প্যালাস বা কর্দ্মাক্ত ক্ষয় [splash erosion] - বৃষ্টি যখন শুরু হয় তখন বৃষ্টির ফোটার আঘাতে শুষ্ক মৃত্তিকার ধূলির আবরন অপসারন কে স্প্যালাস বা কর্দ্মাক্ত ক্ষয় [splash erosion] বলে।
শিট বা চাদর ক্ষয় [sheet erosion] - ঝিরঝিরে বৃষ্টিপাত যুক্ত একটি বিস্তৃর্ন অঞ্চলে মৃত্তিকার উপরে থাকা সূক্ষ্ম ধূলিকনা সমূহ যখন জলের সাথে মিশ্রিত হয়ে ধুয়ে চলে যায়, তখন তাকে চাদর ক্ষয় বলে।
নালিক্ষয় [Rill erosion] - চাদর ক্ষয়ের পরবর্তী পর্যায়ে যখন জল গুলি সামান্য ঢালু অঞ্চলে একত্রিত হতে থাকে, তখন সেখানে অল্প গভীরতা যুক্ত সরু নালির সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে দিয়ে জল প্রবাহিত হতে শুরু করে। এভাবে অসংখ্য ছোট ছোট নালীর মধ্যে দিয়ে জলপ্রবাহের ফলে যে ক্ষয় হয়, তাকে নালিক্ষয় বলে।
খাত ক্ষয় [Gully erosion] - এই নালী বাহিত জল যখন পরস্পর মিলিত হয়ে আরো গভীর ও প্রশস্ত খাতের মধ্যে অতি দ্রুত বেগে প্রবাহিত হয়, তখন তাকে প্রনালী ক্ষয় বা খাত ক্ষয় বলে। যে সব স্থানে নালি ও খাত ক্ষয়ের দ্বারা প্রচুর পরিমানে ক্ষয় সাধিত হয় সেখানে বদভূমির বা badland topography সৃষ্টি হয়।
মৃত্তিকার গ্রথন ও গঠন ঃ
মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্য মৃত্তিকার গ্রথন ও গঠন মৃত্তিকা ক্ষয়কে বহুলাংশে নির্ভর করে। মৃত্তিকার গ্রথন স্থূল প্রকৃতির হলে জল অতি সহজেই ভূ- অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বলে পৃষ্ঠ প্রবাহ কম হয় ফলে মৃত্তিকা ক্ষয়ের পরিমানও কম হয়। অপর দিকে কাদা ও পলি কনা দ্বারা মৃত্তিকা গঠিত হলে জল প্রবেশের পরিমান কম হয়। তাই পৃষ্ঠ প্রবাহ বেড়ে গিয়ে মৃত্তিকা ক্ষয় কে ত্বরান্বিত করে। আবার মৃত্তিকা শিথিল গঠন যুক্ত হলে মৃত্তিকা ক্ষয় বেশি এবং সুসংবদ্ধ গঠন যুক্ত হলে মৃত্তিকা ক্ষয় কম হয়।
ভূমির ঢালঃ
ভূমির ঢালের মাত্রার ওপর জলপ্রবাহের দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় বিশেষভাবে নির্ভরশীল। ঢাল বিহীন বা মৃদু সমতলভূমিতে মৃত্তিকা ক্ষয়ের পরিমাণ কম। কিন্তু অধিক ঢাল যুক্ত ভূমিতে উদ্ভিদের আবরণ না থাকলে ভূমিক্ষয় খুব বেশি হয়।
মানবীয় কারণ-
অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষ ছেদন: উদ্ভিদের শেকড় একদিকে যেমন মৃত্তিকাকে শক্তভাবে ধরে রাখতে সাহায্য করে, অন্যদিকে তেমনি জল ও বায়ু প্রবাহের গতিবেগকে প্রতিহত করেও তাদের ক্ষয়কারী ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মানুষ কৃষি, শিল্প, রাস্তাঘাট ও বাসস্থানের ভূমি সংস্থানের প্রয়োজনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃক্ষছেদন করার ফলে মৃত্তিকা স্তর শিথিল হয়ে মৃত্তিকা ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়।
অবৈজ্ঞানিক প্রথায় কৃষিকাজ-" আদিম জনগোষ্ঠীর লোকেরা পাহাড়ি ঢালে বনভূমি পুড়িয়ে মৃত্তিকা খনন করে কৃষি কাজ করে। এক অঞ্চলের মৃত্তিকার উর্বরতা হ্রাস পেলে তারা অন্যত্র গমন করে এবং সেখানেও একই পদ্ধতিতে কৃষি কাজ করে। ফলে পূর্বের পরিত্যক্ত জমির আলগা মৃত্তিকা স্তর সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
ঝুমচাষ – পার্বত্য অঞ্চলে যে স্থানান্তর কৃষি কাজ হয়ে থাকে, তাকে ঝুমচাষ বলে। যার ফলে জঙ্গল পুড়িয়ে জমি পরিষ্কার করে নেওয়া হয় বলে, অরণ্য বিনষ্ট হয় এবং ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায়।
অতিরিক্ত পশুচারন – অত্যাধিক পশুচারনের ফলে মাটি আলগা হয়ে পরে ফলে মৃত্তিকার উপরের আলগা অংশ খুব সহজে বৃষ্টির জলের সাথে ধুয়ে অন্যত্র অপসারিত হয়।
নির্মাণকার্য-মানুষ কৃষির প্রয়োজনে জলাধার ও বাঁধ নির্মাণ করে, ভূমি কর্ষণ করে কৃষি ক্ষেত্র তৈরি করে, যাতায়াতের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট নির্মাণ করে এবং বসতির প্রয়োজনে গৃহ নির্মাণ করে। এইসব নির্মাণকাজের প্রভাবে মৃত্তিকার উপরিস্তর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা ওই দুর্বল মৃত্তিকা স্তর অন্যত্র অপসারিত হয়। ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় ঘটে।
0 Comments