Ad Code

Ticker

7/recent/ticker-posts

কেরালার ওনাম উৎসব


 কেরালার ওনাম উৎসব


আমাদের দেশ ভারতবর্ষে বহু ভাষাভাষী, বহু জাতির মানুষ বসবাস করে থাকেন। আর প্রত্যেকেরই নিজস্ব আঞ্চলিক উৎসব, উপাচার থাকে। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে একটি জাতির স্বকীয়তা, নিজস্ব ধ্যান-ধারনা, আশা-আকাঙ্খা ও আনন্দ-উদ্দীপনার এক উজ্জ্বলরূপ প্রকাশিত হয়। ঠিক সেরকমই কেরালার প্রধান উৎসব হল -- 'ওনাম উৎসব' ; সেখানকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে জানার প্রধান উৎস...।



প্রতি বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এটি পালন করা হয়। কেরালা রাজ্যের প্রতিটি মানুষের কাছে এই উৎসব অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি কেরালার সবচেয়ে বড় উৎসব এবং রাজ্য উৎসব (State Festival)। এই বছর ২২ শে আগস্ট থেকে ২রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে ওনাম উৎসব। সনাতন হিন্দু ধর্মের এই উৎসব সর্বজনীন ও সকল ধর্মের মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। 



পুরাণে কথিত আছে, পুরাকালে এক অসুররাজ মহাবলী কেরালায় রাজত্ব করতেন। অসুর হলেও তিনি ছিলেন বীর এবং অত্যন্ত দানশীল, কর্তব্যপরায়ন। রাজ্যের প্রতিটি মানুষের সুখ , দুঃখ সব কিছু তিনি দেখতেন। ফলে, রাজ্যে ছিল না কোনও অভাব, না ছিল ঐশ্বর্যের কমতি। রাজ্যের প্রতিটি মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেন। ফলে চারিদিকে তাঁর প্রভাব বাড়তে থাকে। একসময় তিনি দেবতাদের পরাজিত করে ত্রিভুবন জয় করেন। এমতাবস্থায় দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন অসুররাজকে দমন করার উদ্দেশ্যে। প্রাথমিকভাবে ভগবান বিষ্ণু মহাবলী দমনে রাজি হননা, কারন মহাবলী ছিলেন একজন সুশাসক এবং ভগবান বিষ্ণুর উপাসক।  দেবতাদের পরাজিত করে মহাবলী এক যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং ঘোষণা করেন যজ্ঞের সময় যে যা চাইবেন, তিনি তাকে তাই দেবেন। দেবতাদের দুর্দশা দেখে ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার রূপে মহাবলীর কাছে সাহায্যপ্রার্থী হন। বামনদেব  অসুররাজের কাছে বসবাসের জন্য তিন পদক্ষেপ মাপের জমি চান। অসুররাজ বামনরূপী বিষ্ণুকে চিনতে না পেরে তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। সুবিশাল আকৃতি ধারণ করে প্রথম পদক্ষেপে বিষ্ণু গোটা পৃথিবী অতিক্রম করেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপে শেষ করেন স্বর্গ ও পাতাল। তৃতীয় পদক্ষেপ ফেলার জায়গা না থাকায় মহাবলী তাঁর মাথা পেতে দেন। বিষ্ণু তাঁর মাথায় পা রাখতেই ভূ-অভ্যন্তরে মৃত্যুমুখে পতিত হন মহাবলী। মৃত্যুর মুহুর্তে মহাবলীকে বিষ্ণু বর প্রদান করেন যে, প্রতিবছর মহাবলী তাঁর প্রিয় প্রজাদের দেখতে একবার আসতে পারবেন। এই আর্শীবাদ নিয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন মহাবলী। মনে করা হয়, এই উৎসবের সময়ে অসুররাজ মহাবলী প্রতিবছর একবার কেরালায় ফিরে আসেন তাঁর প্রজাদের সাথে দেখা করতে। তাঁর আগমন উপলক্ষ্যে পালিত হয় এই ওনাম উৎসব।


বিভিন্ন পর্যায়ে আয়োজিত হয় এই উৎসব। কেরলের এই উৎসব নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেওয়া যাক।প্রতিবছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দশ দিন ব্যাপী চলে এই 'ওনাম উৎসব'। এই দশ দিন নানা আচার ও আয়োজনের মধ্যে পালিত হয়। তবে উৎসবের প্রথম ও শেষ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। 


প্রথম দিন - আথমঃ-

ওনামের প্রথমদিন হল 'আথম'। সকালে স্থানীয় মন্দিরে দেবতার কাছে প্রসাদ নিবেদন করে ওনাম উৎসবের আয়োজন শুরু হয়। সেদিন প্রত্যেক বাড়ির উঠানে ফুলের একবৃত্ত এঁকে ওনাম উৎসবের সূচনা হয়। এই আলপনাকে বলা হয় পোক্কালম। প্রতিদিন এই বৃত্তের সংখ্যা বাড়ে একটি করে। অর্থাৎ, ওনাম দিনের সকালে বৃত্তের সংখ্যা দাঁড়ায় দশটি। সেদিন সকালে ছেলেমেয়েরা শেষ বৃত্ত রচনা করে নানা বর্ণের ফুল দিয়ে, তবে প্রথম দিন হলুদ ফুলের প্রাধান্য থাকে। উৎসবের পরের দিন গুলোয় বিভিন্ন ফুল আল্পনাতে যুক্ত হতে থাকে।

প্রথম দিন ঃ আথম 


দ্বিতীয় দিন - চিথিরাঃ-

উৎসবের দ্বিতীয় দিন সকালে তাদের বাড়িঘর পরিষ্কার -পরিচ্ছন্ন রাখে। স্থানীয়রা উৎসব উপলক্ষ্যে ঘর-বাড়িতে রং করে, আলোক সজ্জা দিয়ে বাড়ির চারপাশ সাজিয়ে তোলে। বাড়ির সদর দরজায় আল্পনা আঁকা হয়।


তৃতীয় দিন - চোধি

উৎসবের তৃতীয় দিন যেন কেনাকাটার উৎসব। উৎসব উপলক্ষ্যে সকলেই তাদের সাধ্যমতো নিজেদের জন্য, পরিবারের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্য উপহার সামগ্রী, উৎসবের পোশাক কিনে থাকেন। 


চতুর্থ দিন - ভিশাকামঃ-   

উৎসবের এই দিন দুপুরে আয়োজন করা হয় মহাভোজের। স্থানীয় মালয়ালম ভাষায় তাকে বলা হয় সাদ্য। কেরালার প্রতিটি বাড়িতেই তা বানানো হয়। একে বারে যাকে বলে পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে রান্না। ২৬ -এর অধিক পদ থাকে খাবারের তালিকায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তিন রকম কলাভাজা, পাঁপড়, থোরান, মেজহুক্কপুরাত্তি, কলান, ওলান, আভিয়াল, সাম্বার, ভাত, ডাল, চার রকম আচার, দুই-তিন পদের পায়েস, সে এক এলাহি ব্যাপার।

চতুর্থ দিন ঃ - ভিশাকাম 


পঞ্চম দিন - আনিঝামঃ-

ওনামে নৌকা বাইচ নিয়ে প্রচুর হইচই হয়। কেরালা হল নদীনালা ও হ্রদের দেশ। সমুদ্রের সমান্তরালে যে লবনাক্ত হ্রদমালা রয়েছে, সেসব এলাকা এই নৌকা বাইচের উত্তম স্থান। আর উৎসবের পঞ্চম দিন সারা রাজ্য জুড়ে আয়োজিত হয়ে থাকে নৌকা বাইচ। বড় বড় নৌকায় ৭০-৮০ জন লোক মহা উৎসাহে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। যে নৌকা প্রথম হয়, তার চালকরা পুরষ্কৃত হন। এই প্রতিযোগিতায় ৪০-৫০ টি পর্যন্ত নৌকা থাকে, যা দেখার জন্য হ্রদ বা নদীর ধারে লোকেরা ভিড় করে নিজ নিজ গ্রামের দলকে উৎসাহ দেন।



ষষ্ঠ দিন - থ্রিকেটা

উৎসবের এই দিনে পোক্কলমের আকার বাড়তে থাকে। অনেকে এই দিনটিতে প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যান। অনেকে আবার পূর্ব পুরুষদের শ্রদ্ধা জানাতে তাদের ভিটেমাটি থেকে ঘুরে আসেন।


সপ্তম দিন - মুলামঃ-

উৎসবের সপ্তম দিনে উৎসব যেন আরও জাঁকজমকপূর্ণ  হয়ে ওঠে। পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে। মন্দির গুলোতে বিশেষ প্রসাদ সাদ্যর আয়োজন করা হয়। বাড়িতে উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেয়েরা কেরালার বিখ্যাত লোকনৃত্য কায়কোট্টিকলির আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও থিরুভাতিরাকলি, পুলিকলি, থুম্বি থুল্লাল ও কথাকলির মতো নৃত্যকলা পেশ করা হয়। শুধু নারীরাই নন, পুরুষরাও এতে অংশ নেন। প্রতিটি নৃত্যই একে অপরের চেয়ে আলাদা।


অষ্টম দিন - পুরাদমঃ-

উৎসবের অষ্টম দিনে মহাবলী ও বামন দেবতার ছোট মূর্তি এনে ফুলের সাজানো আলপনার মাঝে স্থাপন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে মহাবলী রাজ্যবাসী তাদের বাড়িতে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমন্ত্রণ জানায়। পোক্কালমের কারুকাজ যেন আরও আকর্ষনীয় ও বর্ণিল হয়ে ওঠে।


নবম দিন - উথরাদমঃ-

ওনাম সন্ধ্যা হিসেবে দিনটি পালিত হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, উৎসবের শেষ চারদিন রাজা মহাবলী রাজ্য ভ্রমনে বের হয়ে প্রজাদের আশীর্বাদ করেন। তাই উৎসবের শেষ দিনগুলো বিশেষ শুভদিন হিসেবে মানা হয়। নানা উপাদেয় খাবার-দাবার, নানা আনন্দ আয়োজনের মধ্যে দিয়ে উৎসবের এই দিনটি পালিত হয়ে থাকে।


দশম দিন - থিরুভোনামঃ-

ওনাম উৎসবের শেষ দিন হল থিরুভোনাম। সকালে স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে ঘরবাড়িতে নতুন করে আল্পনা দেওয়া হয়। শহর জুড়ে বের হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। এসব শোভাযাত্রায় থাকে কেরালার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত ও নৃত্য।উৎসব উপলক্ষ্যে রাজ্যের গ্রামগুলোতে স্থানীয় নানা ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলার আয়োজন করা হয়।


মূলত কেরলের ওনাম উদযাপন শুরু হয় থ্রিক্কাকারা মন্দিরকে কেন্দ্র করে। এই মন্দিরটি বামনদেব ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে স্থাপিত। এই মন্দির থেকেই যাবতীয় শোভা যাত্রা আয়োজন করা হয়। কথাকলি নাচ থেকে শুরু করে পঞ্চবৈদ্যম পরিবেশন করা হয় এখানে। এই মন্দির থেকে আরাত্তু নামে এক মিছিল বের হয়, যার আকর্ষনে শহরে ভিড় করে পর্যটকরা। হাতির পিঠে এখানে বামনদেবের মূর্তি বসিয়ে চলতে থাকে বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা। অসুররাজ মহাবলীকে অভ্যর্থনা জানাতে কেরলে ওনামের দিন প্রতিটি বাড়ির দরজায় ফুল দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। এই আলপনাকে 'পোক্কালম' বলা হয়। আজকাল অনেক জায়গায় বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, অফিসে ওনামের সময় ফুল দিয়ে আলপনার প্রতিযোগিতাও হয়। ওনাম উৎসবের সময়ে মহিলারা সোনালি পাড় দেওয়া সাদা শাড়ি পরেন। আর পুরুষরা লুঙ্গির মতো করে সাদা অথবা ঘিয়ে রঙের ধুতি ও জামা বা কুর্তা পরেন। ওনামের সময়ে কায়ানকলি, আত্তাকালাম, কুটুকুটু, আম্বেয়াল ও তালাপ্পনথুকলি নামের অনেকগুলি খেলা চালু রয়েছে। এগুলি এই উৎসবে খেলা হয়। ওনাম উৎসবের সময়ে থিরুভাতিরাকলি, কুম্মাত্তিকালি, পুলিকলি, থুম্বি থুল্লাল ও কথাকলির মতো নৃত্য কলা পেশ করা হয়। কেরালার বোট রেস জগৎ বিখ্যাত ম। কেরলের আরানামুলাতে এই নৌকা প্রতিযোগিতা বা বোট রেসের ছবি তুলতে তথা দেখতে ভিড় করেন বহু মানুষ। এজন্য আরানমুলা এলাকার পার্থসারথী মন্দির প্রতিবছর অনুষ্ঠান উদযাপন করেন নৌকা প্রতিযোগিতা। 

পরিশেষে একথা বলা যায়, ওনাম উৎসব আঞ্চলিকতায় স্বতন্ত্র হলেও, এর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সনাতন সংস্কৃতির মূলভাবটি সমুজ্জ্বল রূপে উদ্ভাসিত হয়। 


লেখকঃ- প্রসাদ সাঁতরা (জাঙ্গিপাড়া, হুগলি)

জিওগ্রাফিয়া 

তথ্যসূত্রঃ- BBC News ; CNA ; Wikipedia ; GLC ; India TV ; Zee News ; The Kerala Tourism Blog


Reactions

Post a Comment

0 Comments

Ad Code