USDA কর্তৃক মৃত্তিকার শ্রেনীবিভাগ// Classification of soil by USDA
মৃত্তিকা এক প্রকার প্রাকৃতিক বস্তু যা প্রকৃতির কতকগুলি উপাদান (যেমন - জলবায়ু, জীবজগৎ, আদিশিলা, ভূপ্রকৃতি ও সময়) বা পদ্ধতির (যেমন -হিউমিফিকেশন, খনিজীকরন, এলুভিয়েশন ও ইলুভিয়েশন প্রভৃতি) ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা মৃত্তিকার শ্রেণীবিভাগ করার চেষ্টা করেন কিন্তু ১৯৫০ সাল পূর্ব অবধি সর্বজনগ্রাহ্য নির্দিষ্ট কোন শ্রেনিবিভাগে পৌছানো সম্ভব হয়নি। ১৯৫১ সাল থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের United States Department of Agriculture (USDA) অধীনে আমেরিকার মৃত্তিকা সর্বেক্ষন কর্মীগোষ্ঠী (Soil Survey Staff) এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের বেশ কিছু সংস্থার সহযোগিতায় মৃত্তিকা শ্রেনীবিভাগের একটি সুনিদিষ্ট প্রনালী প্রচলন করেন। USDA কর্তৃক মৃত্তিকা শ্রেনীবিভাগের প্রধান ছিলেন Dr, Guy D. Smith । USDA দ্বারা প্রথম শ্রেণীবিভাগ প্রকাশ করা ১৯৫৩ সালে এবং এর পর ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পরপর ৭ বছর সংস্কার ও পরিমার্জিত করে ১৯৬০ সালে এই শ্রেণীবিভাগটি সম্পূর্ন হয়। তাই একে সপ্তম অভিকর্ষ বা 7th Approximation বলা হয়ে থাকে। এর পরেও এটিকে কয়েক বার সংশোধন করা হয় এবং সবশেষে ১৯৭৫ সালে সর্বজন স্বীকৃত USDA কর্তৃক মৃত্তিকার শ্রেনীবিভাগ টি প্রকাশিত হয়।
USDA সিস্টেমের অধীনে মৃত্তিকাকে প্রথমে ছয়টি ক্রমান্বয়িক স্তরে বা পর্যায়ে ভাগ করা হয়। যথা -
1. Orders বা ক্রম (১১টি)
2. Sub Orders বা উপক্রম (৬০টি)
3. Great Soil Groups বা প্রধান গোষ্ঠী বা শ্রেণী (২২৫টি)
4. Sub Soil Groups বা উপগোষ্ঠী বা শ্রেণী (১০০০টি)
5. families বা বর্গ (৫০০০টি)
6. Series বা গন (১২০০০টি)।
Orders বা ক্রম - মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া গুলির পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে সারা পৃথিবীতে প্রাপ্ত মৃত্তিকা গুলি মোট ১১ টি ক্রমে ভাগ করা হয়। মৃত্তিকা গুলি পৃথক ভাবে চিহ্নিত করার জন্য ল্যাটিন, গ্রিক ও ফ্রেঞ্চ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং প্রতিটি শব্দের শেষে Sol শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যা ল্যাটিন শব্দ সোলাম থেকে এসেছে, যার অর্থ হল মৃত্তিকা।
১. মলিসল [Mollisol] - মলিসল শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Mollis থেকে যার অর্থ নরম। মলিসল জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর মৃত্তিকা যা নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত শীতল ও শুষ্ক জলবায়ু অঞ্চলে সৃষ্ট হয়ে থাকে। জৈব পদার্থ বেশি থাকায় এই মৃত্তিকা গাঢ় কালো রঙের হয়। পৃথিবীর মোট ভূভাগের প্রায় ৭% অঞ্চলে এই প্রকার মৃত্তিকা দেখা যায়। এই ধরণের মৃত্তিকা প্রধানত ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
উদাহরণ - চারনোজেম, চেস্টনাট মৃত্তিকা মলিসল বর্গের অন্তর্গত।
২. স্পেডোসল [Spodosol] - স্পেডোসল শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Spodos থেকে যার অর্থ ছাই বা ভস্ম । এই ধরণের মৃত্তিকা প্রধানত শীতল ও আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত সরলবর্গীয় বনভূমি অঞ্চলে দেখা যায়। মাঝারি প্রকৃতির বৃষ্টিপাত ও শীতল জলবায়ুর জন্য বাষ্পীভবন প্রায় হয় না বলে সারাবছর ধরে লিচিং বা ধৌত প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়, তাই এই মৃত্তিকার পরিলেখ গুলি সুস্পষ্ট ভাবে বিকাশ প্রাপ্ত হয়, তাই এই ধরণের মৃত্তিকাকে আদর্শ মৃত্তিকা বলা হয়ে থাকে। এই ক্যালসিয়াম জাতীয় ক্ষারকীয় পদার্থ অপসারিত হয়ে যায় বলে মৃত্তিকা আম্লিক চরিত্রের হয়। এই প্রকার মৃত্তিকা পৃথিবীর প্রায় ২.২% স্থান অধিকার করে আছে। স্পেডোসল ক্রমের অন্তর্গত মৃত্তিকা গুলি সামান্য ধূসর বা ছাই রঙের হয়।
উদাহরণ - পডসল মৃত্তিকা
৩. ভার্টিসল [Vertisol] - ভার্টিসল শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Verti থেকে, যার অর্থ Invert বা বিপরীত। ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে সৃষ্ট যে মৃত্তিকায় কর্দম কনার পরিমান বেশি থাকে, তাকে ভার্টিসল মৃত্তিকা বলে। কাদা কনার পরিমান বেশি থাকায় এই মৃত্তিকা জলের সংস্পর্শে ফুলে ওঠে বা স্ফীত হয় আবার শুকিয়ে গেলে এই মৃত্তিকায় অসংখ্য ফাটলের সৃষ্টি হয়, একে গিলগাই বলে অর্থাৎ জলের উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এক রূপ থেকে আর এক রূপে পরিবর্তিত হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও সুদানে এই মৃত্তিকা বিস্তার অনেক বেশি। ভার্টিসল মৃত্তিকায় ক্যালসিয়াম কার্বনেটের প্রাধ্যন্য দেখা যায় বলে এই মৃত্তিকা ক্ষারকীয় প্রকৃতির হয়।
উদাহরণ - ব্যাসল্ট জাতীয় শিলা থেকে সৃষ্ট এঁটেল মাটি বা কৃষ্ণ মৃত্তিকা এই প্রকার মৃত্তিকার উদাহরন।
৪. হিস্টোসল [Histosol] - হিস্টোসল শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Histos থেকে যার অর্থ Tissue । হিস্টোসল জাতীয় মৃত্তিকার উপরিস্তরে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ পুরু স্তরের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ হিস্টোসল হল জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর মৃত্তিকা। ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে কর্দমাক্ত জলা জায়গায় এই ধরণের মৃত্তিকা দেখা যায়। তাই এই ধরণের মৃত্তিকা সারা বছর জলে ভিজে অবস্থায় থাকে।
উদাহরণ - জলাভূমি অঞ্চলে সৃষ্ট এই ধরণের হিস্টোসল জাতীয় মৃত্তিকা বগ, পিট, গ্লেই, মোর প্রভৃতি নামে পরিচিত।
৫. অক্সিসল [Oxisol] - ফ্রেঞ্চ শব্দ Oxide থেকে অক্সিসল শব্দটির উৎপত্তি। অক্সাইড শব্দটির দ্বারা আম্লিক মৃত্তিকাকে বোঝানো হয়ে থাকে। অক্সিসল গভীরভাবে আবহবিকার গ্রস্ত অত্যন্ত প্রবীন মৃত্তিকা। এই মৃত্তিকায় কোয়ার্টজ, কেওলিনাইট জাতীয় কর্দম কনা, লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের প্রাধান্য দেখা যায়। মকরক্রান্তী ও কর্কটক্রান্তী অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে এই মৃত্তিকা দেখা যায়। অধিক বৃষ্টিপাতের জন্য ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় খনিজ জলের সাথে দ্রবীভূত হয়ে অপসারিত হয় বলে মৃত্তিকায় কেবলমাত্র লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম খনিজের প্রাধান্য থাকে, তাই এই মৃত্তিকা আম্লিক চরিত্রের হয়। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল ও আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকার নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলে এই মৃত্তিকা অধিক দেখা যায়। এই মৃত্তিকার জলধারন ক্ষমতা ও পুষ্ঠিমৌলের পরিমান অনেক কম।
উদাহরণ - ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা এই প্রকার মৃত্তিকার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ।
৬. অ্যান্ডিসল [Andisol] - অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট লাভা গঠিত অঞ্চলের আবহবিকারের ফলে যে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয় তাকে অ্যান্ডিসল মৃত্তিকা বলে। লাভা গঠিত শিলা থেকে সৃষ্ট হয় বলে এই মৃত্তিকার বর্ন কালো হয়, এছাড়া প্রচুর জৈব পদার্থের উপস্থিতির জন্য এই মৃত্তিকা খুব উর্বর হয় এবং এর জলধারন ক্ষমতাও অনেক বেশি হয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলা বরাবর এই প্রকৃতির মৃত্তিকা বেশি দেখা যায়।
উদাহরণ - ভারতে ডেকানট্রাপ অঞ্চলে গঠিত কৃষ্ণ বা রেগুর মৃত্তিকা এই ক্রমের অন্তর্গত।
৭. এরিডিসল [Aridisol] - Arid অর্থাৎ মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলে উৎপন্ন মৃত্তিকা কে এরিডিসল মৃত্তিকা বলা হয়। মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমান খুবই কম তাই মৃত্তিকার উপরিস্তর থেকে ক্যালসিয়াম জাতীয় পদার্থ অপসারিত হতে পারে না আবার বৃষ্টিপাত অপেক্ষা বাষ্পীভবনের পরিমান বেশি হওয়ায় মৃত্তিকার নীচের স্তর থেকে জল কৌশিক প্রক্রিয়ায় উপরে উত্থিত হলে জলের সাথে ক্যালসিয়াম উপরে উঠে সঞ্চিত হতে থাকে, তাই এই মৃত্তিকা গুলি পেডোক্যাল গোত্রীয় হয়ে থাকে। মরু অঞ্চলে গাছপালার পরিমান কম থাকায় জৈব পদার্থের পরিমানও কম। তাই এই মৃত্তিকা অনুর্বর প্রকৃতির হয়ে থাকে। সাহারা মরুভূমি অঞ্চল, গোবি মরুভূমি অঞ্চল, মধ্য ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, আটাকামা মরু অঞ্চল ও মেক্সিকোর শুষ্ক অঞ্চলে এই প্রকারের মৃত্তিকা পাওয়া যায়।
উদাহরণ - সেরোজেম, সোলানচাক মৃত্তিকা।
৮. এন্টিসল [Entisol] - এন্টিসল হল এক প্রকার নবীন মৃত্তিকা। এই প্রকার মৃত্তিকা নির্দিষ্ট কোন আদিশিলা থাকে না। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্ষয় প্রাপ্ত শিলা সমূহ বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা পরিবাহিত হয়ে কোন নিচু স্থানে সঞ্চিত হতে থাকলে এই মৃত্তিকার বিকাশ শুরু হয়। যেহেতু ক্রমাগত এই মৃত্তিকা নতুন নতুন পদার্থ এসে সঞ্চিত হতে থাকে তাই সুস্পষ্ট কোন স্তর এই মৃত্তিকায় থাকে না। সাধারণত জলপ্রবাহ বা বায়ুপ্রবাহ এই মৃত্তিকা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
উদাহরণ - পলি মৃত্তিকা ও লোয়েশ মৃত্তিকা এই প্রকার মৃত্তিকার উদাহরণ।
৯. ইনসেপ্টিসল [Inceptisol] - এন্টিসল মৃত্তিকার থেকে সামান্য বিকশিত মৃত্তিকা হল ইনসেপ্টিসল। পৃথিবীর যে সব অঞ্চলে সারা বছর ধরে সামান্য ধৌত প্রক্রিয়া কার্যকর হয় সে সমস্ত অঞ্চলে এই ধরণের মৃত্তিকা দেখা যায়। এটি একটি পরিনত মৃত্তিকা এবং এতে আবহবিকার গ্রস্থ খনিজের উপস্থিতি দেখা যায়।
উদাহরণ - রেগোসল, লিথোসল প্রভৃতি।
১০. আল্টিসল [Ultisol] - ল্যাটিন শব্দ Ultimus থেকে Ultisol শব্দটির উৎপত্তি। এখানে Ultimus বলতে Ultimate বা অন্তিম কে বোঝানো হয়েছে। মধ্য ও নিম্ন অক্ষাংশীয় জলবায়ু অঞ্চলে উৎপন্ন হওয়া সবচেয়ে পরিনত মৃত্তিকা হল আল্টিসল। এই মৃত্তিকায় আদিশিলার কোন চিহ্ন থাকে না। এই ধরনের মৃত্তিকা প্রায় কয়েক হাজার বছরের ব্যবধানে সৃষ্ট হয়ে থাকে।
উদাহরণ - পৃথিবীর প্রধান প্রধান মৃত্তিকা সমূহ এই ক্রমের অন্তর্গত। যেমন - ল্যাটেরাইট, পডসল, চারনোজেম প্রভৃতি।
১১. আলফিসল [Alfisol] - আলফিসল শব্দটি আল (Al) মানে অ্যালুমিনিয়াম এবং ফি (Fe) মানে লোহা বা ফেরাস অক্সাইড এর সমন্বয়ে গঠিত। অর্থাৎ অ্যালুমিনিয়াম ও লৌহ সমৃদ্ধ আম্লিক মৃত্তিকা সমূহ এই প্রকার মৃত্তিকার অন্তর্গত। অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে যেখানে ধৌত প্রক্রিয়া অধিক কার্যকরী হয়, সেখানে এই ধরণের মৃত্তিকা বেশি দেখা যায়।
উদাহরন - পডসল ও ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা।
১২. জেলিসল [Gelisol] - সাম্প্রতিক সময়ে আরো একটি নতুন ক্রম বা Order এই USDA এর Soil Taxonomy সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তার নাম জেলিসল। যা প্রধানত তুষারবৃত অঞ্চলে সৃষ্ট এক প্রকার সিক্ত মৃত্তিকা। অর্থাৎ মেরু অঞ্চলের মৃত্তিকা বলতে জেলিসল মৃত্তিকাকে বোঝানো হয়ে থাকে।
উদাহরন - তুন্দ্রা মৃত্তিকা
0 Comments