উত্তরাখণ্ডের পথেই কি এবার
দার্জিলিং?
২০১৩ সালে
কেদারনাথে প্রবল্বৃষ্টি , মেঘাভাঙা , নদীতে জলস্ফীতি এবং হিমবাহ হ্রদ ভাঙায়
উত্তরাখণ্ডের বহু জায়গাতে ধস নামে ফলে প্রায় ৫৮০০ জন মানুষ প্রান হারায়, যা শুধু কেদারনাথবাসী নয় সারা ভারতবাসী
ভুলতে পারেনি। ভুমিধস তাও পার্বত্য অঞ্চলে, এটি
পরিচিত ঘটনা। ধস একটি ভূজলগত
বিপর্যয়( GEO HYDROLOGICAL DISEASTER) যা আকস্মিক ভাবে মানুষের জীবনে হানা দিয়ে অনেক প্রাণ কেড়ে নেয়। বর্তমানে মানুষ পরিবেশকে যে ভাবে ব্যবহার করছে তার জন্যে
নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা একদম যুক্তিযুক্ত “প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত
প্রতিক্রিয়া আছে।“ ( Every actions
has their counter reaction) অর্থাৎ মানুষ যেভাবে পরিবেশকে ব্যবহার করবে ঠিক
তেমনই ফিরে আসবে আমদের কাছে,যেমন এখন সারা বিশ্বের ত্রাস হচ্ছে করোনা যেটি একটি
জৈবিক বিপর্যয়। ঠিক তেমনি একটি ভূজলগত বিপর্যয়
হল এই ভুমিধস যা সমভূমিকে প্রভাবিত না
করলেও পার্বত্য অঞ্চলে এর বেশ প্রভাব। দার্জিলিং , পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানের
কারণে ভুমিধসের বেশ প্রভাব দেখা যায়। কি এই ভুমিধস? পার্বত্য অঞ্চলে পাতসংস্থানগত
, ভূমিকম্পের ফলে ভুমির ঢাল বরাবর অভিকর্ষজ টানের ফলে শিলায় উপস্থিত পদার্থসমূহ নীচে
নেমে আসে তাকে ভুমিধস বলে। বিষয়টিকে একটি
সমীকরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা যায় তাহলে , F = W * SINØ এখানে Ø= ঢালের কৌণিক মান, F = অভিকর্ষজমান , W= উপস্থিত পদার্থ সমূহ ।এখানে ঢালের সাথে অভিকর্ষজ মানের ব্যস্তানুপাতিক
সম্পর্ক। ঢাল যত বেশী হবে ভুমিধস এর মাত্রা তত বেশী। THE UNITED STATE GEOLOGICAL SURVEY (
USGS) অনুসারে ভুমিধসের সংজ্ঞা হল “ A landslide is defined
as the movement of mass of rock, debris or earth down slope”. ভারতে ভুমিধসের ঘটনা অনেক আছে কিন্তু
পশ্চিমবঙ্গের রানী হিমালয়ের কোলে অবস্থিত দার্জিলিং বিগত কয়েক দশক ধরে ধসের কবলে
পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উত্তরতম জেলা হল দার্জিলিং যা ২০৯২.৫ বর্গ কিমি এলাকা
জুড়ে অবস্থিত । ২৭º
০৪’ ১০” উত্তর থেকে ৮৮ º২৬’৬৩” পূর্ব অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে
অবস্থিত এটি একটি স্থলবেষ্টিত জেলা যার পশ্চিমে আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা পৃথক
হয়েছে নেপাল, উত্তরে সিক্কিম রাজ্যের সীমানা , দক্ষিণে উত্তর দিনাজপুর এবং পূর্বে
জলপাইগুড়ি। কালিম্পং , কার্শিয়াং , মিরিক গুরুত্ব পূর্ন শহর। দার্জিলিং এর বুকে ভুমিধসের ঘটনা আবহ মান কাল
ধরে চলে আসছে। The United Nations International
Strategy for Disaster Reduction and Centre for Research on the Epidemiology
of disasters ( 2006) একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে দশটি বিধ্বংসী
বিপর্যয় রয়েছে তারমধ্যে চতুর্থ নম্বরে ভুমিধস। দার্জিলিং এ ভূমিধসের কারণ হিসাবে
দেখা যায় যে, ১.হিমালয় নবীন ভঙ্গিল পর্বত যার গঠন কাজ এখনও চলছে। টার্সিয়ারি যুগে
ভারতীয় উপদ্বীপীয় মহাদেশীয় পাত ও ইউরেশীয় মহাদেশীয় পাতের মুখোমুখি সংঘর্ষে টেথিস
মহীখাতে পলি সঞ্চয়ে হিমালয় গঠিত হয়েছে। তাই ভুমি অনেকটাই টলমল , যে কারণে পাতের
চলনে মাটি কেঁপে উঠলে ধস নামার সম্ভবনা থাকে। ২। ভূমিরূপগত ভাবে দার্জিলিংকে চার
ভাগে ভাগ করা যায়। নিস শিলাস্তর, গন্ডোয়ানা শিলাস্তর , দার্লিং শিলাস্তর এবং
টার্সিয়ারি শিলাস্তর , নিস শিলাস্তরেই ৪৬% ধসের ঘটনাগুলি হয়ে থাকে, এটি সবচেয়ে
বেশী ধস প্রবন অঞ্চল, কারণ
আবহাবিকারের ফলে শিলার শল্কমোচন হলে তা দুর্বল হয়ে পড়ে ফলে
ধস নামাতে সাহায্য করে। ৩। দার্জিলিং হিমালয়ে বেলেপাথরের পরিমাণ বেশী, ফলস্বরূপ মাটির
গ্রথন ও গঠন দুর্বল চরিত্রের হওয়ায়
বৃষ্টির জল সহজেই মাটির মধ্যে ঢুকে যায় ফলে ধস নামার সম্ভবনা থাকে। ৪।
শিলার কাঠিন্য ও ভঙ্গুরতা কম , ৫। দার্জিলিং এ গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেশী
জুলাই মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বাধিক হয় ৭৯৮ মিলিমিটার, অতিবর্ষণের কারণে
পাথুরে মাটি ভিজে থাকে যারফলে মাটি আলগা হয়ে ঢাল বেয়ে নেমে আসে। ৬। আগেই বলেছি যে
অভিকর্ষ বলের সাথে ঢালে উপস্থিত পদার্থের ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক।ঢাল যত খাড়াই হবে
অভিকর্ষ টান তত বেশী হবে। এছাড়াও কিছু মনুষ্যসৃষ্ট কারণ রয়েছে যেমন জনসংখ্যার চাপ
,নগরায়ন, বৃক্ষছেদন , অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে
কৃষিকাজ , পাহাড়ের ঢালে বসতি নির্মাণ , সড়ক পথ নির্মাণ , খননকাজ , ডিনামাইট ফাটিয়ে
পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি প্রভৃতি কারণে ধস নামে। দার্জিলিং এ যে যে ধরনের ভুমিধস
হয়ে থাকে সেগুলি হল ১। শিলাচ্যুতির স্থলনের
(ROCK
FALL)প্রভাবে প্রায় ২১% ধসের ঘটনা হয়ে থাকে, ২। পাহাড়ের ঢালে বসতি
নির্মাণের ফলে অবস্কর স্থলন( DEBRIS FALL) হয়ে থাকে ১৮% । ৩।৩১% ঘটনা
শিলা ধস ( ROCK SLIDE) এর কারণে হয়ে থাকে।৪। ৩০% ধস অতিবর্ষণের ফলে আকস্মিক অবনমন( SLUMP) হয়ে থাকে। জে ডি হুকার ১৮৫৪ সালে ভুমিধস নিয়ে আলোচনা করেন। প্রাচীন তথ্য
থেকে জানতে পারা যায় যে ২৪শে সেপ্টেম্বর
১৮৯৯ সালে টানা তিনদিনের বৃষ্টিতে ধস নামে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১০৬৫.৫
মিলিমিটার এর প্রভাবে দার্জিলিং শহর , কার্শিয়াং , কালিম্পং , ঘুম, তিন্ধারিয়া এবং
তুভেকার চা বাগান প্রভৃতি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৭২ জন মানুষ প্রাণ হারায় এবং
অব্জার্ভেটারি পাহাড়ের ধারে বাড়িগুলি ধসে পড়ে। এর পরবর্তী ঘটনাগুলি হল যথাক্রমে ১৯৩৪
সালের ১৫ই জানুয়ারি বাংলা বিহার সীমান্তে ভুমিকম্পের ফলে , ১৯৫০
,১৯৬৮,১৯৮০,১৯৯১ , ১৯৯৩, ১৯৯৭ , , ১৯৯৮, ২০০৩ এবং ২০০৫
সালে মূলত অতিবর্ষনে ধসের কবলে পড়ে ও
ক্ষতির সম্মুখীন হয় । সম্প্রতি ২০১৫ তে একবছরে প্রায় ২৫ টির বেশী ভূমিধসের ঘটনা
ঘটেছে। ২০১৬ সালে চার বার ধসের কবলে পড়ে দার্জিলিং। ২০১৯ সালে আবারও ধসের কবলে পড়ে
অতিবর্ষণের কারনে,এবং ২০২০ সালে ১৪ই মার্চ অতিবৃষ্টির জন্যে লোধামা অঞ্চলে ধসের
মুখে পড়ে ৩ জন প্রান হারায়।উপরোক্ত ঘটনাগুলির জন্যে মানবজীবনে যে প্রভাবগুলি পড়ে
তা হল ১। বিগত কয়েক দশকে ধসের কবলে প্রচুর
মানুষ প্রাণ হারায়। ২। রাস্তাঘাট বিপর্যস্ত হয় । বিগত কয়েক দশক ধরে হিল কার্ট রোড ( NH55) , NH10 , NH31 এবং SH12 প্রভৃতি সড়কপথগুলি অনেকবার ধসের কবলে পড়ে যোগাযোগ
ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ১৯৫০ সালে ধসের কবলে পড়ে শিলিগুড়ি ও কালিম্পঙ্গের
রেলপথটি চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় ৩। কৃষিকাজ ক্ষতির মুখে পড়ে । ৪। পাহাড়ের
ধারে বসতি স্থাপনের ফলে ধসের কবলে বাড়ি ঘর ভেঙে পড়ে। ধসপ্রবন এলাকাগুলিকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়ঃ ১। উচ্চ ধসপ্রবনঃ তিন্ধারিয়া পাগলাঝোরা পংখাবাড়ি,
লধামা, কার্শিয়াং, মহানদী, কালিম্পং এবং দার্জিলিং শহর.২। মাঝারি ধসপ্রবনঃ তুকভার
, সিংতম, হ্যাপি ভ্যালি , রঙ্গিত এবং লেবং ৩। নিম্ন ধসপ্রবনঃ উত্তর তুকভার ,
বাদামতাম, গিং, পাদাম , দার্জিলিং শহরের দক্ষিণ দিক প্রভৃতি । দার্জিলিঙকে উত্তরাখণ্ডের সাথে তুলনা
করার কারণ হল ২০১৩ সালে উওরাখন্ডে ধ্বংসলীলার পর ২০১৫ সালে প্রায় ২৫বার ধসের কবলে
পড়ে দার্জিলিং।এছাড়াও বিজ্ঞানীদের মতে দার্জিলিঙের বিপন্নতা উওরাখন্ডের মতই।উত্তরবঙ্গ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হিমালায়ান স্টাডিজ এর গবেষকরা বলেছেন যে হিমালয়ের পাদ
দেশের উপর ENVIRONMENTAL STRESS অনেক গুন বেড়েছে । ১৮৭২ সালে যেখানে
জনঘনত্ব ছিল ২৯ জন প্রতি বর্গ কিমিতে , ২০০১ সালে ৪২১ এবং ২০১১ সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮০
প্রতি বর্গকিমি। এছাড়াও যদি বিপন্নতার
মাত্রার তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যায় যে জনঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, শিলার গঠন, ভুতাত্তিক অবস্থান
, ভুমিকম্পের মাত্রা , বৃক্ষছেদন, বসতি নির্মান , সড়কপথ প্রভৃতির অবস্থা প্রায় সমান।একটি প্রকল্পের তথ্যসুত্র
থেকে জানা যায় যে প্রায় ২০০টির বেশী ধস প্রবন অঞ্চল রয়েছে দার্জিলিংএ।ভবিষ্যতে আরও
বড় ধসের সম্মুখীন হতে পারে এই দার্জিলিং। সেই
জন্যেই উওরাখণ্ডের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু কতগুলি পরিকল্পনামাফিক প্রতিরোধ
ব্যবস্থা হয়ত ধসপ্রবন এলাকাগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারবে যেমন ১।
অঞ্চলগুলির ভূতাত্ত্বিক চরিত্র বিশ্লেষণ করা.২। বৃক্ষরোপণ করা। ৩। পাহাড়ের ঢালে
বসতি নির্মান বন্ধ করা । ৪। পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে যথাযথ
পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়িত করা। ৫ মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো।
সর্বশেষে বলা যায় যে বিগত কয়েক দশকে ধসের নানান ঘটনার সাক্ষী এই দার্জিলিং।শুধুমাত্র অতিবৃষ্টি
নয় বেশিটাই মানুষের যথেচ্ছ বিচরনের কারণে বারে বারে বিপদের মুখে পড়ে মানুষই ।এখন যদি সচেতন
না হয় তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।
সায়ন্তনী
সিং।
@প্রথম প্রকাশ ভূগলিকা ফেসবুক পেজে
তথ্যসূত্রঃ
1. Wikipedia
2. India today
3. Times of India
4. Hindustan times
5. ndtv
6. Landslide prone areas in Darjeeling hills.
7. Integrating spatial, temporal, and magnitude
probabilities for medium scale landslide risk analysis in Darjeeling,
Himalayan, and India.
1 Comments
Nice
ReplyDelete