কলকাতা বা হুগলি শিল্পাঞ্চল (Calcutta or Hooghly Industrial Region)
অবস্থান (Location) : হুগলি নদীর উভয় তীরে কলকাতা এবং এর সংলগ্ন এলাকাগুলিকে নিয়ে এই শিল্পাঞ্চল গঠিত। উত্তরে ত্রিবেণী-হালিশহর থেকে দক্ষিণে উলুবেড়িয়া-বিড়লাপুর পর্যন্ত হুগলি নদীর উভয় তীরে প্রায় 72 কিমি. দীর্ঘ এবং প্রস্থে গড়ে প্রায় 6 কিমি. জায়গা জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের এই সর্ববৃহৎ এবং ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। কলকাতাকে কেন্দ্র করে এই শিল্পাঞ্চলটি গড়ে উঠেছে বলে একে কলকাতা শিল্পাঞ্চলও বলা হয় (চিত্র 8.2)। কলকাতা, 24 পরগনা (উত্তর ও দক্ষিণ), হাওড়া, হুগলি ও নদিয়া জেলার কিছু অংশ নিয়ে এই অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে।
হুগলি বা কলকাতা শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার কারণ (Factors of Growth of Hooghly or Calcutta Industrial Region) : যেসব অনুকূল কারণে এই শিল্পাঞ্চলটি গড়ে উঠেছে সেগুলি হল—
(1) কলকাতা বন্দরের সুবিধা : কলকাতা বন্দর এই শিল্পাঞ্চলকে সারা বিশ্বের বড়ো বড়ো বাজারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এর ফলে যন্ত্রাংশ বা কাঁচামাল আমদানি করা এবং শিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানি করার কোনো অসুবিধা নেই।
(2) হুগলি নদীর জ নদীর জলপথের মাধ্যমে সুলভে পণ্য আদান-প্রদান করা যায়। এ ছাড়া, প্রয়োজনীয় জলও হুগলি নদী থেকে পাওয়া যায়।
(3) কয়লা ও বিদ্যুতের সুবিধা : রানীগঞ্জ ও ঝরিয়া অঞ্চল থেকে আনা কয়লা এখানকার কারখানাগুলিতে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া, ব্যান্ডেল, কোলাঘাট, সাঁওতালদি, টিটাগড়, সুর্গাপুর প্রভৃতি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। বস্তুত, 1854 সালে রানীগঞ্জের সঙ্গে রেলপথে কলকাতার যোগাযোগ হওয়ার পর থেকে জ্বালানির ব্যাপারে এখানে সমস্যা নেই।
(4) বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধা : ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ ও দামোদর হুগলি শিল্পাঞ্চল বা কলকাতা শিল্পা ভ্যালি কর্পোরেশন প্রভৃতি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলির উপযুক্ত পরিকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে।
(5) স্থানীয় কাঁচামাল : ছোটনাগপুর অঞ্চলের খনিজ কাঁচামাল ও স্থানীয় পাট, বাঁশ, রাসায়ানিক দ্রব্য প্রভৃতি সাহায্য পাওয়া যায় বলে হুগলি অঞ্চলে কারখানার সমাবেশ ঘটেছে।
(6) উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা : পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথ এবং অনেকগুলি জাতীয় রাজপথ, যেমন – কলকাতা-মুম্বাই রোড, কলকাতা-চেন্নাই রোড, গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড প্রভৃতির মাধ্যমে এই অঞ্চলটি দেশের অবশিষ্টাংশের সঙ্গে যুক্ত। কলকাতার দমদম বিমান বন্দরের মাধ্যমেও বিদেশের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে হুগলি শিল্পাঞ্চলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। (7) সুলভ শ্রমিকও হুগলি শিল্পাঞ্চল ও সংলগ্ন এলাকার লোকবসতি ঘন। ফলে একদিকে যেমন সুলভে শ্রমিক পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনই শিল্পজাত দ্রব্যের যথেষ্ট চাহিদাও সৃষ্টি হয়।
(৪) মূলধন ও কারিগরিবিদ্যা : পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ মূলধন ও স্বাধীনতার পরে টাটা, বিড়লা, গোয়ো প্রভৃতি স্থানীয় ব্যাবসায়ী সমাজের মূলধনের সাহায্যে এবং কারিগরি সহায়তায় এখানে শিল্প গড়ে তোলা সহজ হয়েছে।
(9) ঐতিহাসিক কারণ : 1911 সাল পর্যন্ত ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা এবং তারপরেও ব্রিটিশ শাসিত ভারতের এটাই ছিল অন্যতম প্রধান কর্মকেন্দ্র। ফলে ব্রিটিশরা কলকাতা এবং তার আশেপাশে শিল্প স্থাপনে বিশেষ আগ্রহী ছিল। শিল্প স্থাপনের জন্য প্রশাসনিক, ব্যাংকিং এবং বিভিন্ন সরকারি সহায়তা পেতে তাই কোনো অসুবিধা হয়নি। (10) বাজার : হুগলি শিল্পাঞ্চলের জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের সুবিধা আছে।
এইসব বিভিন্ন অনুকূল কারণে এই শিল্পাঞ্চলটি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছে.
হুগলি শিল্পাঞ্চলের প্রধান প্রধান শিল্প (Major Industries of Hooghly Industrial Region) এখানকার প্রধান শিল্প হল – পাটশিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, কার্পাস-বানশিল্প, কাগজশিল্প, রাসায়নিক শিল্প প্রভৃতি।
■ পাটশিল্প : ভারতে প্রথম পাটকল রিষড়ায় 1859 সালে স্থাপিত হয়। স্থানীয় কাঁচাপাট, কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি ও যন্ত্রাংশ আনার সুযোগ, সুলত শ্রমিক প্রভৃতি সুবিধার জন্য এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এখানে 71টি পাটকল অবস্থিত। হুগলি নদীর উভয় তীরে পাটশিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলি হল – বজবজ, বিড়লাপুর, উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইল, জগদ্দল, কাঁকিনাড়া, বৈদ্যবাটি, ভদ্রেশ্বর, আগরপাড়া, - শ্যামনগর, বালি প্রভৃতি।
■ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প : ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প এখানকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। (1) ডানকুনিতে EMU কোচ নির্মাণ, (2) লিলুয়া ও কাঁচরাপাড়ায় রেলইঞ্জিন মেরামতের কারখানা, (3) গার্ডেনরীচে জাহাজ নির্মাণ কারখানা, (4) দমদমে জেসপ-এর রেলের ওয়াগন, ক্রেন প্রভৃতি তৈরির কারখানা, (5) বেলঘরিয়ায় টেক্সম্যাকোর বয়ন শিল্পের যন্ত্রপাতি-নির্মাণ কারখানা, (6) কাশীপুর ও ইছাপুরে গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরি এবং এছাড়া সেলাই মেসিন, বৈদ্যুতিক পাখা, রেডিও, টেলিভিশন, নাটবল্টু, কব্জা প্রভৃতি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানাও এখানে আছে।
■ চর্মশিল্প : কলকাতার ট্যাংরা, লেদার কমপ্লেক্স এবং পার্কসার্কাস অঞ্চলে প্রচুর চামড়ার কারখানা আছে। বজবজের কাছে বাটানগরে ভারতের অন্যতম বৃহৎ জুতা প্রস্তুতের কারখানাটি অবস্থিত।
কার্পাস-বয়নশিল্প : ভারতে প্রথম কাপড়-কল 1818 সালে কলকাতার কাছে ঘুষড়িতে স্থাপিত হয়। আমদানি করা তুলা, স্থানীয় বিপুল চাহিদা, স্থানীয় মূলধন, শ্রমিক, শক্তিসম্পদ, রাসায়ানিক দ্রব্য প্রভৃতির সাহায্যে এখানে বন্ধুকল গড়ে উঠেছে।
■ কাগজ শিল্প : ভারতে প্রথম আধুনিক কাগজকল স্থাপিত হয় 1870 সালে কলকাতার কাছে বালিতে। ত্রিবেণীতে উন্নতমানের টিস্যু কাগজ উৎপাদিত হয়।
■ ,রাসায়ানিক শিল্প : কস্টিক সোডা, সোডা অ্যাশ, সালফিউরিক অ্যাসিড প্রভৃতি রাসায়ানিক এখানে উৎপন্ন হয়। রিষড়া, কোন্নগর, পানিহাটি প্রভৃতি এই শিল্পের কেন্দ্র। এ ছাড়া, কলকাতার আশপাশে বিভিন্ন স্থানে ফিনাইল, রং, পলিথিন, প্লাস্টিক, বার্নিশ, কালি প্রভৃতি তৈরির কারখানা তৈরি হয়েছে।
■ অন্যান্য শিল্প ঃ এ ছাড়া, হুগলি শিল্পাঞ্চলে আরো বিভিন্ন ধরনের শিল্প আছে, যেমন – (1) ডানলপে রবার কারখানা, (2) বিড়লাপুরের লিনোলিয়াম ও ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রস্তুতের কারখানা, (3) বেলুড়ে অ্যালুমিনিয়াম কারখানা, (4) কল্যাণীর সুতার কল, (5) খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ( 6 ) IT শিল্প, (7) কমপিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়ার শিল্প, (৪) বজবজ ও ডানকুনিতে ইলেকট্রিক রেলইঞ্জিন ও কোচ নির্মাণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
হুগলি শিল্প ঞ্চলের সমস্যা (Problems) :
(1) কাঁচামালের সমস্যা।
(2) কলকাতা বন্দরের সমস্যা।
(3) শিল্পাঞ্চলের অপ্রতুল পরিকাঠামো।
(4) অসম মূলধন বিনিয়োগ।
(5) সরকারের অসম শিল্প লাইসেন্স দান নীতি।
(6) পুরোনো যন্ত্রপাতির সাহায্যে উৎপাদন।
(7) শিল্প পরিচালন ব্যবস্থার ত্রুটি।
(৪) শিল্পাঞ্চলের উপর জনসংখ্যার প্রবল চাপ।
(9) জমির অস্বাভাবিক দাম।
(10) দুষণ সমস্যা,
(11) কর কাঠামো,
(12) রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রভৃতি।
হুগলি শিল্পাঞ্চলের সম্ভাবনা (Prospects) :
হুগলি শিল্পাঞ্চলের সম্ভাবনাময় শিল্পগুলি হল— (1) IT শিল্প, (2) রিয়েল এস্টেট শিল্প, (3) খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, (4) রেডিমেড বস্ত্র উৎপাদন শিশু (5) ইলেকট্রনিক এবং ইলেকট্রিক সরঞ্জাম উৎপাদন শিল্প, (6) প্রসাধনী দ্রব্য উৎপাদন শিল্প (7) মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণ শিল্প।
বস্তুত, পাট শিল্পের অবক্ষয়ের পরে কলকাতা-হুগলি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক-নির্ভর শিল্পের যে অবনতি হয়েছে, তার পুনরুদ্ধার সম্ভব না হলেও আগামী দিনে MSME (Micro Small, Medium Enterprise) ক্ষেত্রে উন্নতির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
0 Comments