ওড়িশার স্বাভাবিক উদ্ভিদ
ওড়িশার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত যা রাজ্যের মোট ভূমি ক্ষেত্রের প্রায় ৩৭.৩৪ শতাংশ৷ দক্ষিণ ও পশ্চিম ওড়িশার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে এই বনভূমি গুলি আবৃত হয়েছে৷ উপকূল সংলগ্ন পূর্ব সমভূমিগুলি সাধারণত খামার জমি বা চাষাবাদের জমি৷ ওড়িশার বনভূমি বিশালাকার, ওড়িশার মোট ভৌগলিক ক্ষেত্র ১৫৫,৭০৭ বর্গকিমির মধ্যে প্রায় ৫২,৪৭২ বর্গকিমি অঞ্চল বনভূমি দ্বারা আবৃত৷ ওড়িশার বনভূমির উদ্ভিদগুলির প্রকৃতিগতভাবে প্রানজ্জল বিকাশের দরুন এখানে বৃহৎ জীববৈচিত্রের সৃষ্টি হয়েছে যার মধ্যে বন্য গাছপালা(Flora) এবং প্রাণীজ প্রজাতির(Fauna) এক বৃহৎ সমাহার লক্ষ করা যায়, ওড়িশায় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যগুলি এর প্রমাণ৷
ওড়িশার বনভূমির প্রকার
Champion and seth শ্রেনিবদ্ধকরন অনুসারে ওড়িশায় ১৮ ধরনের বনভূমির উপস্থিতি রয়েছে৷ তবে মূলত, ভূমিরূপ, বৃষ্টিপাত এবং গাছপালার ধরনের ভিত্তিতে ওড়িশার বনভূমিগুলিকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়, সেগুলি হল —
১. উত্তর ক্রান্তীয় আংশিক-চিরসবুজ বনভূমি
২. ক্রান্তীয় আর্দ্র পর্ণমোচী বনভূমি
৩. ক্রান্তীয় শুষ্ক পর্ণমোচী বনভূমি
৪. ম্যানগ্রোভ বনভূমি
১. উত্তর ক্রান্তীয় আংশিক-চিরসবুজ বনভূমি
সাধারণত ময়ুরভঞ্জ (Mayurbhanj), ঢেঙ্কানাল (Dhenkanal), আঠগড় (Athgarh), পুরী (Puri), নয়াগড় (Nayagarh), পার্লাখেমুদি (Parlakhemudi), কোরাপুট (Koraput) এবং কালাহান্দি (Kalahandi) বন বিভাগের ৬০০ মিটার উচ্চতায় নিচু পাহাড় এবং উপত্যকায় এই ধরনের বনভূমি দেখা যায়৷
এই অঞ্চলে শীর্ষ তলের উদ্ভিদগুলি সাধারণত পর্ণমোচী জাতীয় উদ্ভিদ এবং অল্প সময়ের জন্য পাতাহীন থাকে৷ নিন্ম তলের উদ্ভিদগুলি চিরসবুজ জাতীয় উদ্ভিদ৷
এখানকার বিশেষ উদ্ভিদ প্রজাতি গুলি হল- অর্জুন (Arjun), আম (Mango), মনকরকেন্দু (MankarKendu), চম্পা (Champa), রাই (Rai), মান্দা (Manda) এবং নাগেস্বর (Nageswar)৷
২. ক্রান্তীয় আর্দ্র পর্ণমোচী বনভূমি
এটি মৌসুমি বনভূমি নামেও পরিচিত৷
ময়ূরভঞ্জ (Mayurbhanj) ও কেওনঝড় (Keonjhar) জেলার নিন্ম উচ্চতায় এবং ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় এই ধরনের বনভূমি দেখা যায়৷
এখানকার শীর্ষ অংশটিতে শাল (Sal) গাছ এবং এর সহযোগী আসন (Asan), পিয়াসাল (Piasal), কুরুম (Kurum), কংরা (Kangra), ধাওড়া (Dhawra) এবং ডাবা বাঁশ (Daba bamboo) প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে৷
৩. ক্রান্তীয় শুষ্ক পর্ণমোচী বনভূমি
এই ধরনের বনভূমি শুষ্ক মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে বালাঙ্গির (Balangir), কালহান্দি (Kalahandi), সম্বলপুর (Sambalpur), খারিয়ার (Khariar), দেওগড় (Deogarh) এবং গোবিন্দপুর (Gobindpur) রাজ্যের বিভাগগুলিতে দেখা যায়৷
এই বনভূমিগুলিতে শাল (Sal) গাছের পরিবর্তে সেগুন (Salia) এবং দাবা বাঁশের (Daba bamboo) পরিবর্তে সালিয়া বাঁশ (Salia bamboo) লক্ষ করা যায়৷
৪. ম্যানগ্রোভ বনভূমি
এই ধরনের বনভূমি খুব সামান্য অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিস্তৃত এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ৷ বিশেষত ভিতরকণিকা (BhitarKanika) এবং মহানদীর (Mahanadi) বদ্বীপে এই ধরণের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ দেখা যায়৷
এখানে বৈশিষ্ট্যযুক্ত গাছের প্রজাতি গুলি হল- করিকা (Karika), সুন্দরী (Sundari), বনি (Bani), রাই (Rai), গুয়ান (Guan) (Exocaria) ইত্যাদি৷
এখানে গুচ্ছের আকারে প্রচুর পরিমানে হেন্টাল (Hental) জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায়, তাই ম্যানগ্রোভ বনভূমি গুলিকে স্থানীয়ভাবে Hental van বলা হয়৷
ওড়িশায় বনভূমির প্রাচুর্য বা গুরুত্ব
ওড়িশার বনভূমিটি হল বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ও উপকারী গাছের ভাণ্ডার যেমন ভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের কাঠ (Timber species), সমৃদ্ধ ঔষধি গাছ (Rich Medicinal plants), সুগন্ধি গাছ (Aromatic plants) ৷ মোট বনভূমির প্রায় ৩৩ শতাংশ শাল (Sal) গাছ এবং তার সহযোগী প্রজাতি দ্বারা আবৃত৷ বাকি অংশটি সেগুন (Teak), পিয়াসাল (Piasal), বাঁধন (Bandhan), কাঙ্গাদা (Kangada), কাশি (Kasi), সিসু (Sisu), আসানা (Asana), কুরাম (Kuram) এবং ধেউড়ার (Dheura) মত প্রাজাতি দ্বারা আচ্ছাদিত৷ বাঁশ (Bamboo)( ২৬%) হল এখানকার প্রধান প্রজাতি যা শুষ্ক ও আদ্র উভয় পর্ণমোচী বনভূমির উদ্ভিদ৷
কাষ্ঠ প্রজাতি(Timber species)
শাল ছাড়াও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাষ্ঠ প্রজাতি গুলি হল সেগুন (Teak), পিয়াসাল (Piasal), বাঁধন (Bandhan), কাঙ্গাদা (Kangada), কাশি (Kasi), সিসু (Sisu), আসানা (Asana), কুরাম (Kuram) এবং ধেউড়ার (Dheura)৷ বিভিন্ন ধরণের বাঁশ (Bamboos), শাল বীজ (Sal seeds), রজন (resins), কেন্দু পাতা (Kendu leaves), বেত (Canes), চন্দনের কাঠ (Sandal wood), হরীতকী (Myrobalans), সালাপ (Salap) এবং অন্যান্য ছোট ছোট বনজ পণ্য রাজ্যের বনজ আয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস৷
পরিবেশগত দিক থেকে দক্ষিণ ওড়িশা দুটি বৃহত্তম প্রজাতি শাল ও সেগুনের মিলনস্থল৷
সমৃদ্ধ ঔষধি বৃক্ষের প্রাজাতি(Rich Medicinal plants)
সিমলিপাল (Similipal) এবং পৌরানিকভাবে বিখ্যাত গন্ধমর্দন (Gandhamardan) পাহাড় হল দেশীয় ভেষজ উদ্ভিদের সম্ভাব্য উৎস৷ সর্পগন্ধা (Sarpagandha) বা পাতালগারুদার (Patalgaruda) মত বিপন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গাছ ওড়িশার বনভূমি থেকে পাওয়া যায় যা সাপের কামড় বা অন্যান্য রোগের চিরাচরিত প্রতিকার হিসাবে ব্যবহার করা হয়৷
এছাড়া সাসামারি (Swasamari), কোচিলা (Kochila), করুয়ান (Koruan) এবং থানকুনি (Thalkudi) জাতীয় কয়েকটি সাধারন ভেষজ উদ্ভিদ এখানে দেখা যায়৷
সুগন্ধি প্রজাতির গাছ(Aromatic plants)
কিয়া(Kiya)- উপকূলীয় অঞ্চলে জন্মায়, বিশেষত গঞ্জাম জেলায়৷
শাল(Sal)- এটি ওড়িশার একটি সাধারন প্রজাতি, শাল গাছের আঠা থেকে যে রজন বের হয় তা আমরা ধূপ ও ধূনা হিসাবে বাবহার করি৷
শিটরাস(Citrus)- এই ধরণের প্রজাতির গাছের ছাল, ফুল ও পাতা বেশ সুগন্ধযুক্ত৷ শিটরাস তেল সুগন্ধি দ্রব্য এবং ঔষধির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়৷
ভাটিভার(Vetiver)- এই প্রজাতির শিকড় গুলি থেকে উচ্চ মানের আতর বা সুগন্ধি তৈরি হয়৷
বন্য লেমন ঘাস(Wild Lemongrass)- ওড়িশার সিমলিপাল (Similipal), কোরাপুট (Koraput), খারিয়ার (Khariar), কপিলাস (Kapilas) এবং গঞ্জম (Ganjam) জেলার শীতল পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতে কয়েকটি বিশেষ প্রজাতির লেমন ঘাস দেখা যায়৷ বিশেষ কোনো ব্যবহার না থাকলেও ঘর বা চাল ছাওয়ার কাজে লাগে৷
ওড়িশায় বনভূমি সংরক্ষন
ওড়িশার বন ও পরিবেশ দপ্তর রাজ্যের বন ও গাছপালা সমূহ সংরক্ষন, পুনর্জন্ম এবং সম্প্রসারনের জন্য বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ গ্রহণ করে৷ রাজ্যের বনভূমি পরিচালনা ও সংরক্ষনের জন্য গাইডিং নীতি যেমন National Forest Policy 1988, Orissa Forest Sector Vision 2020 and Joint Forest Management Resolution এর প্রয়োগ করা হয়৷ এছারাও স্থানীয় জনগনের অংশগ্রহণমূলক কাজের মাধ্যমে বনভূমি ও উদ্ভিদ সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷
তথ্যঃ- Orissa psc exam notes, Govt of Orissa – Department of Forest and Environment, ENVIS – Centre of Odisha’s State of Environment, Wikipedia, Orissa reference annual 2011, Orissa state forest department.
আন্দুল, হাওড়া
@জিওগ্রাফিয়া
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
0 Comments